বারী যতখানি চিন্তিত নয়, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত মুখ করে বসে থাকে। একটু পর বলে, উনি বেলকিশ থেকে আসছিলেন, পথে আমাকে তুলে নিলেন। আমি কিছু জানতাম না।
ও।
তাও উনি ওখানে আমাকে কিছু বলেন নি। পথে শুনলাম। তা আপনার ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে, আবার ঠিক হয়ে যাবে। ব্যবসায় ওঠানামা তো আছেই। কী বলেন ডাক্তার সাহেব? ভাইয়ান হকচকিয়ে তাড়াতাড়ি জবাব দেয়, হাঁ, তাতো বটেই।
দু মিনিটও হয় নি, এর ভেতরই অধির বোধ করছে সে। কখন মেয়ে দেখা যাবে? ভেতরে নিয়ে যাবে? না এখানেই দেখাবে? মেয়ের সঙ্গে আলাদা একটু কথা বলা যাবে তো? মেয়ে স্বয়ং না হোক, মেয়ের ছোট বোন দুটিকেও একবার দেখা যাচ্ছে না কেন? পাত্র বাড়িতে এসেছে, তাদের কি কোনো কৌতূহল নেই!
আলি দু হাতের করতল চিৎ করে বলেন, এবার নামারই পালা, বুঝলেন? বাংলাদেশের যা পরিস্থিতি আপনি তো প্রত্যেক বছরই যাচ্ছেন, আপনিই ভালো বলতে পারবেন মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এতদিন শিক্ষিতলোক, দেশের উপকারে আসবে, এই জানতাম, এখন। দেখছি, শিক্ষিত হলেই বাইরে ছোটে না। আর শিক্ষিতদেরই বা দোষ দেই কেন? মিডিল ইস্টে আপনার কী বলে, সাধারণ লোক, মজুর, ড্রাইভার, বাবুর্চি ছুটছে না?
বারী এখানে বাধা দেয়।
একটা তফাত আছে আলি সাহেব। ওরা যারা যাচ্ছে, দেশে গিয়ে তো কয়েকবারই দেখলাম, দু হাতে টাকা উপার্জন করে, জিনিসপত্র কিনে দেশে ফিরছে, দেশে জমি কিনেছে, বাড়ি কিনেছে। আর শিক্ষিত লোক, তারা রোজগার করে বিদেশেই খরচ করছে, বিদেশেই বাড়ি গাড়ি করছে। আমরাই বা কী করছি? এই যে ভাইয়ান সাহেব, তা আপনার দশ বছর হয়ে গেল না? আমার তো তারো বেশি, আমরা এখানে পড়ে আছি, দেশে যাব, দেশে গেলে আমারই সমসাময়িক ডাক্তারেরা সব পোস্ট দখল করে বসে আছে, কেউ মন্ত্রী হয়েছে, কেউ গুলশানে বাড়ি টাড়ি করে ফেলেছে, আমরা গেলে কনুই মেরে বার করে দেবে, দেশে যাচ্ছি না তা আপনার কথাই ঠিক, দেশে কেউ আর ফিরে যাচ্ছে না।
বারীর ধারণা, এবং তার আশেপাশের বন্ধু বাঙালি ডাক্তারদের ধারণা, সে খুব বলিয়ে কইয়ে লোক, রাজনীতিও খুব ভালো বোঝে। তাই ভাইয়ানের মতো অনেক ডাক্তারই তাকে কাজ কর্মে সঙ্গে রাখে। তার কথার তোড়ে গরম বোধ করে। আসলে, বারী যে এক কথা থেকে আরেক কথায় লাফ দিয়ে যায়, দুটো কথার ভেতরে যুক্তির ফাঁক গমগমে আওয়াজ দিয়ে ভরিয়ে দেয়, এটা হঠাৎ কারো চোখে পড়ে না। তার কথায় শেষে সকলেই, বুঝুক আর না বুঝুক, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাতে হয়।
অভ্যেস বশে ভাইয়ানও চিন্তিত মুখ সৃষ্টি করে।
আলি সেটা লক্ষ করেন। তার চৈতন্য হয়, মেয়ে দেখতে এসেছে, দেরি হয়ে যাচ্ছে, আর মোটেই শোভন দেখাচ্ছে না।
আরো কিছু সময় নেবার জন্যে, পরিস্থিতি সামাল দেবার উপায় ভেবে নেবার জন্যে আলি এই আলোচনার জের টেনে বলেন, গুলশানের কথা বলছিলেন, ডাক্তার সাহেব। সেদিন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বিমান আপিসে দেখা। মাস তিনেকের জন্য এসেছেন। ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। তিনি এক কথা বললেন।
বারী ভ্রূ তুলে অপেক্ষা করে। দেয়ালে প্যান আমিরিকান-এর এক পোস্টারে সহাস্য এক তরুণীর জীবন্ত ছবি দেখে অজান্তে তার হাত উঠে যায় টাকে। বার দুয়েক বুলিয়ে নেয়। আলি বলেন, সেই ভদ্রলোক বলছিলেন, গুলশানে আর একটি বাড়িও থাকবে না।
কেন?
পাবলিক একটা একটা করে ইট খুলে নেবে। বেশিদিন আর বাকি নেই।
রেভেলেউশন তো একটা হওয়া দরকার, আলি সাহেব। তবে, হবে বলে আমার মনে হয় না। বাঙালিকে কিছুটা চিনি তো? হোটেলের সামনে ফেলে দেওয়া খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে, হোটেলে ঢুকে কেড়ে খাবে না। এই হচ্ছে আপনার বাঙালি। নাহ্, আপনার ভদ্রলোকের কথা মানতে পারলাম না। হলে তো ভালোই।
ভাইয়ান এবার স্থির হয়ে গেছে। প্রথম ঢুকেই যে উত্তেজনা বোধ করছিল, কিছুতেই শান্ত হয়ে বসতে পারছিল না, এখন সে যেন অন্ধ নিয়তির হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে।
আলি উঠে দাঁড়ান।
ওপরে একটা খবর দিয়ে আসি।
ডাঃ ইউনুস ভাইয়ানের বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে। ট্রাউজারের ভেতরে শিরশির করতে থাকে। একাধিক শ্বেতাংগিনীর সাহচর্য পাবার পরও, তার নিজেরই বিশ্বাস হয়ে যায়, সে এখনো কুমার।
১১. অত্যন্ত নিশ্চিত ও মূল্যবান সামগ্রী
ইয়াসমিন, তুমি আমার দক্ষিণ পার্শ্বে উপবেশন কর। ইহা অত্যন্ত নিশ্চিত ও মূল্যবান সামগ্রী। বহুকষ্টে জোগাড় করিয়াছি।
ভিনসেন্টের নির্দেশে তার ডান পাশে গিয়ে ইয়াসমিন বসে। বাম পাশে গ্যাবি, তারপরে পিটার, কোকো, জো, প্যাম, মার্ক, মার্কের পরেই ইয়াসমিন–এইভাবে বৃত্ত রচনা করে বসেছে ওরা। ইয়াসমিন ভেবেছিল, বস্তুটা গাঁজা জাতীয় কিছু হবে, সিগারেটের মতো টানতে হবে। কিন্তু না, আয়োজন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিনসেন্ট দ্রুত হাতে অথচ সাবধানে একটা ছোট গোল শিশি বের করে, তার ভেতরে শাদা গুঁড়ো। অতি সূক্ষ্ম সেই গুঁড়ো। পাউডারের মতো।
ইহা তুমি পছন্দ করিবে।
ধূপদানেব মতো ছোট্ট একটা জিনিস বের করে ভিনসেন্ট। হাত বাড়ায়। কেউ তাকে একটা দেশলাই দেয়।
ইহা নাসিকা দিয়া গ্রহণ করিতে হয়।
ভিনসেন্ট ধারাবিবরণী দিয়ে চলে। ধূপদানের মতো বস্তুটির ভেতরে গুঁড়ো সামান্য একটু ঢেলে, শিশির মুখ বন্ধ করে সে।