বলে, দৈর্ঘ এবং আয়তন জানিতে চাও বটে। তবে তোমারটা দেখিয়া বিবেচনা করিব, চলিবে কি না।
প্যাম ওদিক থেকে বিরক্তিসূচক শব্দ করে ওঠে, আহ, তোমরা কী লাগাইলে? আমার ধ্যান ভঙ্গ করিয়া দিলে?
জো বলে, ইয়াসমিনের সঙ্গে কে পারিবে? পিটার? শুস।
প্যাম তখন জো-কে নিয়ে পড়ে।
এই তোমার ধ্যান? তুমি সব শুনিতেছিলে। আমি মন্দিরে গিয়া গুরুকে বলিয়া দিব।
ইয়াসমিন হেসে উঠে বলে, কেন? গুরুকে নালিশ দিবে কেন? শয্যায় অস্ত্র প্রয়োগ করিবে। জো সিধা হইবে।
প্যাম তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে আবার ধ্যানে বসে।
মার্ক, আমার ক্ষুধা পাইয়াছে।
সংগীত ছাড়া আপাতত আমার কাছে দ্বিতীয় কোনো আহার্য নাই।
তুমি কি অনাহারে থাকিবে?
হাঁ, অন্য ব্যবস্থা না হইলে, সন্ধ্যাবেলায় চ্যারিং ক্রস যাইব। সেখানে পাদ্রীরা সুপ বিতরণ করিতে প্রত্যহ আইসে।
তোমার কি অর্থ নাই?
ছিল, ফুরাইয়া গিয়াছে। সোমবারে ভাতা তুলিব, তবে খাইব।
ইয়াসমিন নিজের ক্ষিদে সত্ত্বেও মার্কের ক্ষিদের জন্যে কষ্ট পেতে থাকে। ভিনসেন্ট লকেট বেচে সব টাকাই গাঁজায় খরচ করবে, না খাবারও আনবে— সেই সংশয়ে কিছুক্ষণ সে দোলে। প্রার্থনা করে, ভিনসেন্ট যেন কিছু খাদ্য আনে।
গান শুনিবে, ইয়াসমিন? তবে শোন। ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলিয়া যাইবে।
১০. শাপলা ট্রাভেল এজেন্সির সাইনবোর্ড
শাপলা ট্রাভেল এজেন্সির সাইনবোর্ড দেখেই ডাঃ বারী বলে ওঠে, আরে, এখানে নাকি? মেয়ে কার? আলি সাহেবের?
ডাঃ ইউনুস ভাইয়ান ফর্সা মানুষ। লজ্জায় রাঙ্গা হলে সহজে বুঝা যায়। সেটা গোপন করবার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে বলে, হাঁ। বড় মেয়ে।
আশ্চর্য, ফি বছর টিকিট নিচ্ছি আলি সাহেবের কাছ থেকে, একবারও তো শুনি নি, মেয়ে আছে।
যুক্তিটা দুর্বল। টিকিট নিলেই টিকিটদাতার পারিবারিক সব খবর ক্রেতার জানা হয়ে যাবে, বা হওয়া উচিত, এটা কোনো কথা নয়। বারী নিজেও সেটা অন্য সময় হলে বুঝত। কিন্তু, প্রতি বছর সে দেশে গেছে পাত্রী খুঁজতে, সে পরিপ্রেক্ষিতে এখানকার এই আবিষ্কার সত্যি তাকে ক্লিষ্ট করে। রুহুল কুদুস একবারে পাশ করেছে, সে পারে নি, দুপুরে সেটা মনে করেও এখনো বুকের ভেতর খচখচ করছে।
গাড়ি থামিয়ে বারী গম্ভীর মুখে বেরিয়ে আসে। ভাইয়ান থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। ভাইয়ানের একবার মনে হয়, তাকে না বলে এতদূর টেনে আনাটা বোধহয় ঠিক হয় নি। লোকটা সত্যি সত্যি রাগ করেছে। পুষিয়ে দেবার জন্য সে খুব চটপটে হয়ে বলে, বেশিক্ষণ বসব না। এক নজর দেখা, এই তো! আপনার ওপর খুব ডিপেন্ড করছি। আপনিই দেখবেন, আপনি বললে করব, নইলে নয়।
তেলটাতে বিশেষ কাজ হয় বলে মনে হয় না। বারী প্রায় স্বগতোক্তির মতো উচ্চারণ করে, আমি নিজের ওপর স্বয়ং নির্ভর করতে পারি না।
পাশাপাশি দুটো দরোজা। বাড়ির ভেতরের ওপর তলায় যাবার দরোজাটা নিরেট কাঠের। তার পাশেই আপিসে ঢোকার দরোজা স্বচ্ছ কাচের। ভাইয়ান বারীকেই সমুখে ঠেলে দেয়। আপিস থেকেই মিষ্টার আলি দেখতে পেয়েছিলেন ওদের। স্বাভাবিক পরিস্থিতি হলে সাগ্রহে উঠে এসে আপ্যায়ন করে ভেতরে আনতেন, এখন ওদের দেখা মাত্র তার মনে হলো, যদি পালিয়ে যেতে পারতাম। ইয়াসমিনের অনুপস্থিতির কী ব্যাখ্যা দেবেন বহু ভেবেও তা ঠিক করে উঠতে পারেন নি। শেষে ভবিষ্যতের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন নিজেকে। এটুকু স্থির করেছেন, ইয়াসমিন বাড়িতে নেই বলবেন, বাকিটা অবস্থা দেখে বানিয়ে নেবেন।
এই মুহূর্তে তার মনে হলো কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকাই ভালো। তিনি কাচের দরোজার ওপারে ওদের দেখেই বিরাট এক ফাইল খুলে বসেন।
দরোজা ঠেলে প্রথমে ঢোকে বারী, পেছনে ভাইয়ান।
বারীকে দেখে অবাক হন আলি। ভাইয়ানের দিকে চোখ যেতে চায় তার, তিনি শাসন করে রাখেন। হাত বাড়িয়ে দেন বারীর দিকে।
আরে, আপনি, আসসালামুআলাইকুম, আসুন, আসুন। ভালো আছেন? ম্যানচেস্টারেই আছেন? এমনভাবে কথা বলেন তিনি যেন দ্বিতীয় আর কেউ নেই সেখানে।
বারী পরিচয় করিয়ে দেয়।
ইনি আমার বন্ধু ডাঃ ইউনুস ভুইঞা, বেলশিলে থাকেন।
মিস্টার আলি একটা মিথ্যা কথা বলেন, ও তাই তো! আপনার আসবার কথা, অপেক্ষাও করছি, অথচ বুঝতে পারি নি। বারী সাহেবকে দেখে মনে করেছি, টিকিটের ব্যাপার কি দেশেটেশে যাচ্ছেন, জিনিস কেনা কাটা আছে। বসুন, বসুন।
দুজনে বসে। আপিসের এক পাশে জোড়া একটা সোফা, সেখানেই বসে তারা। মিস্টার আলি ফাইল বন্ধ করে ক্যাবিনেটে তুলে রাখতে রাখতে বলেন, ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ, ডাক্তার সাহেব।
দুজনেই ডাক্তার, তবু বুঝতে কষ্ট হয় না, উদ্দিষ্ট হচ্ছে ডাঃ বারী।
ভাইয়ান তখন থেকে মুখে একটা স্থির বিস্তৃত হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে। বসে আছে কিন্তু স্বস্তি নেই, একবার পা লম্ব করছে, ভালো লাগছে না; পা ভাজ করছে, আরাম বোধ হচ্ছে না; আবার ডান দিকে একটু কাত হচ্ছে, হাতলে লাগছে; তখন আবার সোজা হচ্ছে; আবার গোড়া থেকে শুরু করছে।
বারী বলে, কেন খারাপ কেন?
আলি এসে চেয়ার টানেন, টেবিলে এক হাত রাখেন, ঠেস দিয়ে বসেন।
খারাপ হবে না? দেশে লোক যাচ্ছে কোথায়? সবাই তো আসছে। বাংলাদেশ থেকে এখানে আসছে। ফেরত যাবার সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে, ডাক্তার সাহেব। আমরা তো এই ব্যবসাই করি, স্ট্যাটিকটিক্স আমাদের কাছে আছে।