আলি আবার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন যেন মনে মনে আবার থানায় ফিরে যান।
কী বলল তারা?
সে আর তুমি শুনে কী করবে? স্ত্রীর দিকে করুণ চোখ তুলে আলি তাকান। আজকাল লন্ডনে বহু ভারতীয় মেয়ে বেশ্যাবৃত্তি করছে। ঐ যে প্লে-বয় বলে একটা খারাপ কাগজ আছে, ওতে নাকি ভারতীয় কোনো এক মেয়ে, কোথায় কোন ব্যাংকে কাজ করে, তার সব বিবস্ত্র ছবি বেরিয়েছে। সেই থেকে ভারতীয় মেয়েদের নাকি খুব চাহিদা। মানে বুঝতেই পারছ, পুলিশ বলতে চাইল, সে রকম কোনো হাবভাব মেয়ের মধ্যে লক্ষ করেছি কি না। কী আর বলব কাকে? নিজের মেয়েকে নিয়ে এ সব কথা শোনাও, কী বলে, মরণতুল্য। নাহ, আমাদের জন্য পুলিশেরও আর কোনো সহানুভূতি নেই দেখলেই তো, দু দুবার আমার এই আপিসের কাচ দুধের বোতল মেরে শাদা ছোকরাগুলো ভাঙল, করল কিছু পুলিশ? এসে শুধু জিগ্যেস, কে মেরেছে, দেখতে কেমন, আবার দেখলে চিনতে পারব কিনা, সাত সতের। আরে, চিনতেই যদি পারব, দেখেই যদি থাকব, তো ছেড়ে দিয়েছি তাকে? দু দুবার ঘটনা, তোমরা একটা পাহারার বন্দোবস্ত করতে পার না? নজর রাখতে পার না? কিছু না পার, দুটো আশা ভরসা তো দিতে পার? নাহ, নাহার, আমার মন উঠে গেছে আজ থানায় গিয়ে। বয়স যদি থাকত, দেশে গিয়ে আবার সব শুরু করবার মতো উপায় যদি থাকত, লাথি মেরে চলে যেতাম। ইয়াসমিন যদি ফিরে আসে, আসবে, কি বল?— এলে ওকে আমি ঢাকায় পাঠিয়ে দেব। মিয়া ভাইয়ের কাছে থাকবে। তারও মেয়ে আছে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। মাহজাবীনকে পাঠিয়ে দেব। দু বছর পরে নাসরিনকেও। ও আমি কাউকে আর এখানে রাখব না!
ইতস্তত করে নাহার বলে, আর আমরা?
হঠাৎ শূন্য চোখে স্ত্রীর দিকে তায় আলি। তারপর দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়। ব্রিফকেস খুলে টিকিট কাগজপত্র বের করে চশমা চোখে দিয়ে পড়বার চেষ্টা করেন। অল্পক্ষণ পরেই ধরা পড়ে, চশমার কাচ যেন অস্বচ্ছ হয়ে গেছে, ধোঁয়াটে লাগছে।
০৮. মাহজাবীন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে
বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাহজাবীন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। এক মুহূর্ত বাড়িতে ভালো লাগে না তার। আবার ইয়াসমিনের মতো তার পছন্দটা অস্পষ্ট নয়। ইয়াসমিন চায় বন্ধনহীন জীবন, শাসন নেই, বাবা-মা, এমনকি স্বামীরও নয়। বিয়ের কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। তবে, কাউকে ভালো লাগলে তার সঙ্গে বাস করতে আপত্তি নেই তার। তেমন ভালো লেগেছে, এখনো কেউ নেই অবশ্য! ইয়াসমিন ভালোবাসে গান, বন্ধুত্ব, পায়ে হেঁটে ভ্রমণ, যাযাবরের মতো খোলা আকাশের নিচে রাতবাস। জীবিকার জন্যে লেখাপড়াকে ঘৃণা করে, বিয়ের। জন্যে নিজেকে বড় করে তোলা তার কাছে কুসংস্কার বলে বোধ হয়। জীবিকা উপার্জনের একটা ধারণা তার আছে। সে কাঠমিস্ত্রি হবে এবং কেবল জানালাই বানাবে। তার মাথায় নতুন নতুন ডিজাইনের জানালা ঘোরে। নিজেকে সে কল্পনা করে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান জানালা নির্মাতা হিসেবে।
আর মাহজাবীন চায় যত শিগগির সম্ভব, সময়কে ঠেসে খাটো করে হলেও, ষোল বছর অতিক্রম করতে। তারপর সে বেরুবার স্বাধীনতা আদায় করে নেবে। বাবা মায়ের কাছ থেকে সে স্বাধীনতা না পাওয়া গেলে বিপ্লবী যেমন দেশত্যাগ করে, সে গৃহত্যাগ করবে। সে ডাক্তারের কাছে গিয়ে মাসের একুশ বড়ি ব্যবহার করবার ব্যবস্থা নেবে। তারপর কিছুদিন ছেলেদের সঙ্গে তারিখ করবে, হল্লা করবে, নাচ করবে, ছেলের গাড়িতে শেষরাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াবে, ছুটির দিনে দূরদূরান্তে যাবে, একদিন বাগদত্তা হবে, বিয়ে হবে, মাহজাবীনের নিজের সংসার হবে। সে পরিষ্কার জানে, রাড়ি থেকে এর কোনোটিই সম্ভব নয়। এমনকি তুচ্ছ সিগারেট পর্যন্ত সে খেতে পারবে না। তাই যতদিন তার মোল বছর না হচ্ছে, চমৎকার অভিনয় করে যাচ্ছে বাড়িতে। সিদ্ধান্ত করে অভিনয় নয়, একটু একটু করে সহজভাবে সে এই কৌশলটি অবলম্বন করেছে।
বেরিয়ে সে চন্দনার বাড়ির কাছাকাছি যায়। চন্দনার কথাটা তখন মনে এসে ভালোই হয়েছে। বরং ওকে নিয়েই ইয়াসমিনের কাছে যাওয়া যাবে। অলবানি স্ট্রীট টিউব স্টেশনের একেবারে কাছে।
পথে লাইব্রেরি পড়ে। বই দুটো চট করে ফিরিয়ে দেয় মাহজাবীন। ফুটপাতে লাল টেলিফোনের বাক্সে ঢোকে। চন্দনাকে ফোন করে দেখে নেয়া দরকার, বাড়িতে আছে কিনা।
ফোন করতে ঢুকে, প্রথমে সে কাঁধের ঝুলি থেকে সিগারেট বের করে। নিপুণ হাতে ধরিয়ে লম্বা একটা টান দেয়। মাথাটা বেশ হাল্কা আর শরীরটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে ওঠে তার।
চন্দা?
বীন?
হাঁ, বীন বলিতেছি। বাড়িতে আছ?
আছি।
তোমার পিতা মাতা?
তাহারা কাজে গিয়াছে। আটটায় ডিউটি শেষ হইবে। তুমি কোথায়?
নিকটেই। আসিতেছি।
চন্দা পৌঁলের বাবা-মা দুজনেই লন্ডন ট্রান্সপোর্ট বাসে কাজ করে, চন্দনা তাদের একমাত্র মেয়ে। ভালোই হলো, খালি বাড়িতে বসে মনের সুখে সিগারেট খাওয়া যাবে।
মিনিট খানেকের ভেতরেই মাহজাবীন পৌঁছে যায়। দরোজা খুলে দিয়েই দুই বন্ধু হেসে গড়িয়ে পড়ে। ঐ বয়সে এভাবেই হাসি পায়; এর বিশেষ কোনো কারণ থাকে না।
ভেতরে ঢুকে মাহজাবীন ব্যাগটা ধপ করে নামিয়ে রেখে সোফার ওপর দুপা তুলে জোড়াসন হয়ে বসে। নিজে আরেকটা সিগারেট ধরায়, চন্দনাকে দেয়।
না, ধন্যবাদ। আমি এই মাত্র একটি শেষ করিয়াছি।