ছোটটিই বা কেমন হবে, কে জানে? আল্লাকে স্মরণ করে নাহার। দেশের বাড়ির জন্য মন হঠাৎ আকূল হয়ে ওঠে। এর চেয়ে অনেক ভালো ছিল ঢাকায় থাকা।
.
ও মা, এর মধ্যে সব করে ফেলেছিস? আমার যে খিদে নেই মা। মিনার জন্যে কিছু ভালো লাগছে না।
তোমার ভালো লাগিবে এবং তুমি আহার করিবে। নহিলে বুঝিব, তুমি আমাদের ভালোবাস না, বুবুকেই ভালোবাস।
অগত্যা খাবার তুলতেই হয় নাহারকে। নাসরিনকে কোলে নিয়ে খেতে থাকে সে।
মাম। মাহজাবীন সাহস করে ডাক দেয়।
কীরে?
আজ শনিবার। পাঠাগারে বই ফিরাইয়া দিবার দিন।
নাহারের একটু খটকা লাগে। এর আগেও গত শনিবার মাহজীবন বই ফেরাতে গেছে, তার জন্যে ঘটা করে অনুমতি নেয় নি। বইয়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলেছে, লাইব্রেরিতে যাচ্ছি।
মায়ের মুখে সহসা মেঘ লক্ষ করে মাহজাবীন তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, তোমাকে একা ফেলিয়া যাইতে চাহি না। অথচ, আজ বই না ফিরাইলে জরিমানা দিতে হইবে।
নাহারের মন থেকে মেঘ কেটে যায়। ইয়াসমিন অমন একটা কাণ্ড করেছে বলেই মেজ মেয়ে মায়ের কথা এত বেশি করে ভাবছে। মাহজাবীনের দিকে তার সমস্ত স্নেহ ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বেশ তো, যা। দেরি করিস না। বাড়িতে মেহমান আসবে।
হাঁ, মাম, তাহাকে কী বলিবে?
জানি না, কী বলব। সে রওয়ানা হয়ে গেছে, ফোন করে মানা করবারও জো নেই।
আমি না হয় একটা মিথ্যা বলিয়া দিব। তাহাকে গল্পে মাতাইয়া রাখিব। সে কেমন হয়, মাম?
নাহার প্রীত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে— বুড়ির মতো কথা তোর!
মাম, পাঠাগারের নিকটেই চন্দনা পৌলদের বাড়ি। ফিরবার পথে চন্দনাকে দেখিয়া আসিব?
উদ্বিগ্ন চোখে মাহজাবীন মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুমতি আদায়ের চেয়েও এই মুহূর্তে তার বড় ভাবনা, মা মিথ্যেটুকু ধরতে পারল কি?
তাহলে নাসরিনকেও নিয়ে যা।
নাসরিন এখনো পড়ছে। সকালের চার্লি ব্রাউন শেষ হয়ে, আরেকটা শেষ হয়ে, তিন নম্বর চার্লি ব্রাউনের বই তার হাতে এখন। নীরবে পড়ে যাচ্ছে আর খাচ্ছে। কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।
বাঁচিয়ে দিল নাসরিনই।
চন্দনাকে আমি পছন্দ করি না। তাহার মাথায় উকুন আছে।
মাহজাবীন ভাংচি কাটে।
উকুন তোমার মাথায়, ক্ষুদে শয়তান।
আমার মাথায় উকুন তোমার মাথা হইতে আসিয়াছে।
নাহার বাধা দেয়।
এই শুরু হলো দুজনের। চুপ কর। আমার মন ভালো নেই।
নাসরিন সহজে ছাড়ে না। মাকে সে মনে করিয়ে দেয়, বুবুর যে ঘর খালি হইয়াছে, আমাকে সেখানে দখল দিবে তো? আমি এই মুখরা বালিকার সহিত এক ঘরে বাস করিব না।
নাহার ধমক দেয়, আহ, রিনা। বুবুকে এভাবে তে নেই।
আমি বলিব।
না, বলবে না।
ঠাস করে পিঠে কিল বসিয়ে দেয় নাহার।
বেয়াদব মেয়ে। বীনা, তুই যাবি তো যা। আমাকে আর তোরা জ্বালাসনে। আমার চোখের সমুখ থেকে দূর হয়ে যা।
মাহজাবীন নাহারের চোখের আড়ালে নাসরিনকে ছোট্ট করে ভাংচি কেটে দ্রুত বেরিয়ে যায়। ওপরে গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে তরতর করে নামে। এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। পাছে, মায়ের মত বদলে যায়। যাবার সময় হল থেকে চিৎকার করে বলে যায়, বিদায়, মাম।
টেলিফোন বেজে ওঠে, মাহজাবীনকে তাড়াতাড়ি ফেরার কথা বলবার আগেই।
নাহার ফোন তুলে নেয়।
শাপলা ট্রাভেল এজেন্সি। হ্যালো।
করিম বলিতেছি।
আপনার টিকিট তো?
হাঁ, প্রস্তুত আছে কি? কখন আসিব? আপনি কি বাংলা বলেন।
হাঁ, আমি মিসেস আলি। উনি একটু পরেই ফিরবেন। আপনি তিনটের দিকে আসুন।
আচ্ছা। আচ্ছা, কবেকার ফ্লাইট বলতে পারবেন, মিসেস আলি?
উনি বলতে পারবেন।
জানতে পারলে ভালো হতো। টেলিগ্রাম করে দিতে পারতাম। বাংলাদেশের ব্যাপার কদ্দিনে পৌঁছায়। আমার আবার আর্জেন্ট ব্যাপার। আচ্ছা, তিনটের সময় আসব।
ফোন রেখে দিতে না দিতেই কাচের ভেতর দিয়ে স্বামীকে দেখতে পায় নাহার। ক্লান্ত পায়ে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে আসছে। রাস্তার ওপারে ক্রসিংয়ে এসে দাঁড়ান আলি। সিগন্যাল দেখে দ্রুত পায়ে পথ পেরিয়ে আবার ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন। হাতের ব্রিফকেসটাও যেন আজ বড় ভারি মনে হচ্ছে। একদিকে একটু ঝুঁকে পড়েছেন।
আলি দরোজা ঠেলে ঢুকতেই নাহার উঠে দাঁড়াল। নাহারের চোখে মুখে ফিরে এলো উদ্বেগ, সকালবেলার সমান মাত্রায়।
টেবিলের ওপর ব্রিফকেসটা নামিয়ে রেখে আলি বলেন, থানায় গিয়েছিলাম। বলে চুপ করে বসে থাকেন। অনেকক্ষণ আর কিছু বলেন না।
কেন, থানায় কেন? কী হয়েছে ইয়াসমিনের?
নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না নাহার। এই সম্ভাবনাটা তার মাথায় আসে নি কেন? মেয়েটি বাড়ি না পালিয়ে আসলে কোনো বিপদেও পড়তে পারে তো? অপহরণ? ধর্ষণ? খুন?
চুপ করে থেকো না, আমাকে বল কী হয়েছে।
না, কিছু হয় নি।
তাহলে থানায় গেলে কেন?
জানিয়ে রাখলাম ওদের। যেখানেই আছে, বেঁচে আছে নিশ্চয়ই। নইলে কোনো দুর্ঘটনার কথা দুজনের কারোরই মনে এলো না কেন? ট্রেনে খবরের কাগজে, কারা ষোল বছরের একটা ইংরেজ মেয়েকে রেপ করে মেরে গেছে, সেই খবর দেখে, মনটা কেমন করে উঠল। গেলাম থানায়। মেয়ের বয়স আইনের চোখে সাবালিকা। স্বেচ্ছায় গেলে তো আর পুলিশ ফিরিয়ে আনতে পারে না। কিন্তু ওদের ব্যবহারটা দেখে অবাক হলাম। আমার গায়ের রঙ দেখে কিনা জানি না, প্রথমে অনেকক্ষণ পাত্তাই দিল না, দাঁড়িয়ে থাকতে হলো, অথচ লন্ডনের পুলিশের কত নাম কত গল্প শুনেছি, নিজেও দেখেছি, আগে এ রকম ছিল না, এখন যেন অন্য রকম, আমার কাছে সব শুনে, তেমন কোনো মেয়ের কিছু হয়েছে বলে তাদের জানা নেই এই কথাটা এমনভাবে বলল, যেন আমি মেয়ের বাবা নই, অন্য কেউ, বাইরের কেউ খামোখা বিরক্ত করতে গেছি। তারপর নাহার, পুলিশ একগাদা আমাকে উপদেশও দিল।