ভিনসেন্ট উঠে আসে ইয়াসমিনের কাছে। বলে, সিগারেট প্রস্তুত, দীক্ষা লইবে না?
০৭. রাগের মাথায় বললেও
রাগের মাথায় বললেও, কথাটা ঠিকই বলেছিল নাহার। মাহজাবীন আসলে ইয়াসমিনের চেয়েও ধুরন্ধর। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না, ভেতরে ভেতরে কী হচ্ছে। এমন চমৎকার তার অভিনয় যে মিস্টার আলির মতো দশ ঘাটের পানি খাওয়া লোক মাহজাবীনের সম্পর্কে একেবারে উলটো ধারণা নিয়ে বসে আছেন।
ইয়াসমিন যে বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে মাহজাবীন তা গতকালই জানত। দুবোনে এ নিয়ে লম্বা পরামর্শও হয়েছে।
আমি কি গোবৎস, বীন, যে একজন কৃষক আমাকে কিনিবার জন্য দেখিতে আসিতেছে? কাল তোমার বিবাহ দিবে, পরশু আমাকেও কাহারো হাতে তুলিয়া দিবে।
এই পিতামাতার হাতে পড়িয়া জীবন একশেষ হইল। হাত খরচের অর্থ পাই না চুরি করিতে হয়, বাহিরে গেলে তিরস্কার শুনিতে হয়, ফোন ব্যবহার করিলে পিতা সর্বস্বান্ত হইবার অভিনয় করেন।
আবার মায়ের বাঙালি বান্ধবীরা আমাদের চলন লইয়া যখন উদ্বেগ প্রকাশ করেন, কেন আমরা গা ঢাকিয়া পোশাক পরি না অনুযোগ করেন, কেন আমরা বাংলা বলিতে পারি না বলিয়া খুঁত ধরেন, তখন মা একেবারে আমাদের লইয়া পড়েন।
উহারা কেবল কারি রাধিতে জানে, জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা নাই।
আমাদের আর-আর বন্ধুরা কী সুখে আছে!
তাই আমি চলিলাম। সাবধান, প্রকাশ না পায়।
পাইবে না।
প্রকাশ হইলে তোমারই মন্দ। তোমাকে আর বাহির হইতে সাহায্য করিতে পারিব না, বীন। ভান করিবে যেন তুমি কিছুই জান না।
তোমাকে আর শিখাইয়া দিতে হইবে না। আমার বয়স যদি মোল হইত, আমিও বাড়ি ছাড়িয়া দিতাম। তোমার মতো স্বাধীন হইতাম।
সেদিন দেখিয়াছি, মালেকা, তোমার বয়সী, দিব্যি বাড়িতে সিগারেট খাইতেছে। তাহার মা কিছুই মনে করে নাই। আমরা বিয়ার লেমনেড দিয়া খাই, তাহার পরে কড়া ঝাঁঝের চুয়িংগাম খাই, তবু আশঙ্কা হয় মা ধরিয়া ফেলিবেন। কেন, আমার কি বয়স হয় নাই? আমি কি আপনার ভালোমন্দ বুঝি না।
খাঁটি কথা বলিয়াছ। তবে, আমাকে তো চুপ করিয়া সহ্য করিতেই হয়। পনের চলিতেছে। আর এক বছর পরে কাহারো তোয়াক্কা করিব না। অ্যালিসনের মতো আমিও সিনেমায় যাইব, জিনজার এল দিয়া হুইস্কি পান করিব, নাচিব, গাহিব, পায়ে হাঁটিয়া বিশ্বভ্রমণ করিব। তুমি ভাগ্যবতী, সতের বৎসর হইয়াছে, তুমি চলিলে, আমি পড়িয়া রহিলাম।
বাড়ি থেকে বেরুবার সময় মা কাছে কাছেই ছিলেন বলে ইয়াসমিন নিজের কিছু কাপড় আর দরকারি জিনিস দুটো ব্যাগে গুছিয়ে রেখেও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে নি। ব্যাগ দেখলেই প্রশ্ন হতো, এমনকি যেমন মা, তল্লাশীও হয়ে যেতে পারত। অবশ্য, একবার বেরিয়ে যাবার পর ফিরে এসে ব্যাগ এবং নিজের সব কিছু নিয়ে যেতে বাধা নেই। মোল বছর বয়স কবেই পার হয়ে গেছে, এখন পুলিশও তাকে বাড়ি ফিরতে বাধ্য করতে পারবে না, এমনকি এখন সে সোজা ডাক্তারের কাছে গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি চাইতে পারে, মা-বাবার অনুমতি লাগবে না। তবু বাড়ি ছেড়ে পরদিনই বাড়িতে ব্যাগ নিতে আসাটা সহজ নয়। মা-বাবা কান্নাকাটি করতে পারে, এবং হাজার হোক তারা মা-বাবা, যত সেকেলেই হোক তারা একেবারে বুকের ওপর দাঁড়িয়ে গলায় পা দেয়া যায় না। তাই শেষ পর্যন্ত মাহজাবীনকে বলে যেতে হয়, সে যেন যে করেই হোক অলবানি স্ট্রীটে ব্যাগ দুটো না হোক অন্তত একটা আজ পৌঁছে দেয়।
দুটো নেয়া মুশকিল হবে। মাহজাবীন বোনের ঘরে ঢুকে, খাটের তলা থেকে ব্যাগ দুটো বের করে দ্রুত হাতে বিশেষ জরুরি জিনিস বেছে নেয়। নিয়ে, একটাতে ভরে ফেলে। তারপর, নিজের ঘরে গিয়ে পড়ার লাইব্রেরি থেকে গত সপ্তাহে ধার করে আনা দুখানা বই সেই ব্যাগের ওপরে সাজিয়ে রাখে।
ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দ্যাখে, মা কোথায়।
নাহার তখন আপিস ঘরেই। মিস্টার আলি বাইরে থেকে ফেরেন নি।
নিঃশব্দে দরোজা খুলে ঢোকে মাহজাবীন। ইতস্তত করে বলে, মাম, নাসরিন ক্ষুধার্ত।
চৈতন্য হয় নাহারের। সকালবেলায় এত বড় একটা ধাক্কায় ছোট মেয়েটির খাওয়ার কথা একবারেই ভুলে গিয়েছিল। উদ্বেগ আর অপরাধবোধ মিশে গিয়ে তাকে ঝাঝালো করে তোলে।
কেন, তুমি কিছু করে দিতে পার নি? দেখছ না আমি আপিসে আছি?
তুমি অহেতুক বকিতেছ। আমি খোঁজ নিতে আসিযাছি, তুমি কিছু খাইবে কি না। নাসরিন এবং আমার বিফবার্গার করিতেছি। তুমি খাইবে তো তোমাকেও করিয়া দিই।
মেয়েটির কথায় হঠাৎ কোমল হয়ে যায় নাহারের মন। আহা, পেটের মেয়ে তো, বড়টির মতো নিষ্ঠুর নয়, মায়ের মন খারাপ দেখে কোনোদিন যা করে না, আজ খাবার তৈরি করে। দিতে চাইছে।
নাহার মেয়ের হাত ধরে কাছে টানে।
কাছে আয়।
মাহজাবীন ভেতরে ভেতরে খুশি হয়। মাকে রাজি করানো তাহলে শক্ত হবে না। চাইকি ঘণ্টা তিনেকের ছুটিও পাওয়া যেতে পারে। তাহলে সোজা অলবানি স্ট্রীট।
নাহার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, মিনার মনে কি দয়ামায়া নেইরে? বাবা-মা, ছোট ছোট দুটো বোন, কারো জন্য মন কাঁদল না?
মাহজাবীন নাহারের গালে ছোট্ট করে চুমো দিয়ে বলে, আর ভাবিও না, মাম। এখন কিছু আহার কর। আমি আনিয়া দিতেছি।
পাখির মতো উড়ে যায় মাহজাবীন। নাহারের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। দুটো মেয়ে দু রকম হলো কেন?