পা আবার টন টন করে ওঠে। বিলকিস অনুমানে খাটের কোণ হাতড়ে বসে পড়ে।
সিরাজ, অন্ধ বুড়ো মানুষ, কেউ তাকে দেখছে না, বলতে গিয়ে হাসলে কেন?
সিরাজ আবার হাসে। খুব সংক্ষিপ্ত মৃদু। তরঙ্গের হাসি। কাছে আসে সে।
আপা, আমি হাসছি না। এটা হাসি নয়, আপা। শুনবেন আলেফ মোক্তারের অবস্থা? কে তাকে দেখে? বিহারী কতগুলো ছোঁকরা আছে, তারা।
বিহারী?
সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে বিলকিস। এ কোথায় নিয়ে এলে তাকে সিরাজ?
হাঁ, বিহারী কয়েকটা ছোঁকরা। প্ৰথমবার জলশ্বেরীতে যখন মিলিটারি আসে, তার আগের রাতে টের পাওয়া গিয়েছিল, ওরা আসবে। ছেলেরা সবাইকে সাবধান করে দেয়। মাঝরাতে সবাই শহর ছেড়ে নদীর ওপারে চলে যায়। বাঙালিদের ভেতরে পড়ে থাকে। শুধু আলেফ মোক্তার। মিলিটারি আসবার পর বিহারীরা দলেবলে বেরোয়, প্রতিটা বাড়ি ঢুকে তছনছ করে, লুট করে। একদল এসে দেখা পায় মোক্তার সাহেবের। তারপর অন্ধ দেখে বদমাশগুলোর ফুর্তি হয়। আলেক মোক্তারের গলায় জুতোর মালা দিয়ে, বুকের ওপর জয় বাংলার নিশান লাগিয়ে কোমরে গরু বাঁধার দড়ি বেঁধে সারা শহর তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। অন্ধ মানুষ, হাঁটতে পারে না, বার বার পড়ে যায়, বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁকে খাড়া করে, লাথি মারে, টেনে নিয়ে বেড়ায়। তারপর ফিরিয়ে এনে একা বাড়িতে রেখে যায়। আবার পরের দিন তাকে নিয়ে বেরোয়, আবার সেই এক বৃত্তান্ত। এরপর মাঝে মাঝেই তাকে নিয়ে এরকম করে। মজা করবাব জন্যে বাঁচিয়ে রেখেছে। তারাই কখনো কিছু এনে খেতে দেয়।
হতভম্ভ হয়ে যায় বিলকিস।
শুনলাম, আজো নিয়ে সারা বিকেল ঐভাবে ঘুরিয়েছে। তারপর থেকে চুপ করে জলচৌকির ওপর বসে আছেন। সিরাজ একটু চুপ করে থেকে বলে, এখানে যা লুট করবার সব নিয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে কেউ আসে না। আর। তাই এখানে আপনাকে নিয়ে এলাম। এখানে ওরা আজ রাতে আর আসবে না। আর এলেও ভেতরে ঢুকবে না। জানেন তো, পালাবার সবচে ভালো জায়গা শত্রুর ঘাটির ভেতরে।
বয়সের তুলনায় সিরাজ তার কথায় যে অভিজ্ঞতার পরিচয় অবলীলাক্রমে দেয়, বিলকিস অবাক না হয়ে পারে না। তার ভাই খোকাও কি এ রকম সাবালক হয়ে গেছে?
বিলকিস আস্তে আস্তে বাইরে আসে। এসে, আলেফ মোক্তারের কাছে দাঁড়ায়।
কে? আঙ্গিনার দিকে চোখ রেখেই চমকে প্রশ্নটা করেন আলেফ মোক্তার।
আমি।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত কিছু আর বলেন না। সিরাজ নিঃশব্দে এসে বিলকিসের পাশে দাঁড়ায়।
হঠাৎ গলা পরিষ্কার করেন আলেফ মোক্তার। সেই অপ্রত্যাশিত শব্দে সমস্ত পরিবেশ যেন চমকে ওঠে। তারপর তিনি, আঙ্গিনার দিকে স্থির চোখ রেখেই, অত্যন্ত. দৃঢ় গলায় বলেন, তোমার বাবা আমার খুব বন্ধু লোক ছিলেন।
তারপর তিনি চুপ করে যান। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বিলকিস, কিন্তু মোক্তার আর কিছু বলেন না!
আপনি ভেতরে যাবেন না?
সাড়া নেই।
ভেতরে আপনাকে শুইয়ে দিই?
তবু কোনো সাড়া নেই।
সিরাজ অসহিষ্ণু গলায় বলে, উনি এখানেই থাকুন না? আপনি ভেতরে যান। আমি ওর কাছে বসছি।
এখানে কতক্ষণ বসে থাকবেন?
বিলকিস সিরাজকে উপেক্ষা করেই মোক্তার সাহেবকে আবারো সম্বোধন করে।
আলেফ মোক্তার হঠাৎ হাহাকার করে ওঠেন, কোথায় যাব? কবরে যাব? আজ এতগুলো ছেলে মেরে ফেলল।
কী? কী বললেন? আর্তনাদ করে ওঠে বিলকিস।
দেখতে পাই না, তবু ওদের মুখ দেখতে পাই।
ফুঁপিয়ে ওঠেন আলেফ মোক্তার। সিরাজ অপ্রত্যাশিত এক কাণ্ড করে বসে। বিলকিসের হাত ধরে, টান মেরে সরিয়ে এনে, ঘরের ভেতর ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। চাপা গলায় গর্জন করে ওঠে, আপনি ভেতরে থাকুন।
না।
পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিয়ে বারান্দায় ছুটে আসে বিলকিস।
কাদের মেরেছে? কোন ছেলেদের?
বিলকিসের বুকের ভেতর ঠাস করে এসে আছাড় খায় খোকার মুখ।
আলেফ মোক্তার এই প্রথমবার আঙ্গিনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হাতড়ে খপ করে বিলকিসের হাতখানা ধরে ফেলেন।
দুর্বল কম্পিত হাতে দ্রুত গতিতে সারা হাত ছুঁয়ে দেখেন। তারপর বলেন, সব লাইন করে। বাজারে। তোমার ভাইয়ের নাম খোকা না?
০৫. আলেফ মোক্তার
আপনি এদিকে আসুন।
সিরাজের কণ্ঠস্বর। থমথমে। বিলকিস বিস্ফারিত চোখে একবার সিরাজ, একবার আলেফ মোক্তারের দিকে তাকায়। তারপর, সিরাজকে অনুসরণ করে ঘরের ভেতরে ঢোকে।
আপনি বসুন।
নিজেই অবাক হয়ে যায়, বিলকিস অত্যন্ত শান্তভাবে খাটের কোণে গিয়ে বসে। সিরাজ একটুক্ষণ সমুখে দাঁড়িয়ে থেকে পাশে বসে তার। আলমারির নকশায় একটা উজ্জ্বল ছোট্ট আলোর বিন্দুর দিকে তাকিয়ে সে বলে, আপনার ভাই খোকা মারা গেছে। এতক্ষণ আপনাকে বলি নি। ভেবেছিলাম, বলব না।
কথাটা বলেই সিরাজ একহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।
বিলকিসের কান্না পায় না। তার মনে হয়, একটা জানা খবরই দ্বিতীয়বার কেউ তাকে শুনিয়ে গেল।
সিরাজের পিঠে হাত রাখে সে।
তখন আরো ফুঁপিয়ে ওঠে সিরাজ। এই ক মাসের প্রতিটি মৃত্যু একের পর এক তরঙ্গের মতো তার দিকে ধেয়ে আসে।
শান্ত কণ্ঠে বিলকিস। উচ্চারণ করে, খোকা নেই?
নিজেকে সামলে নেয় সিরাজ। সামলাতে একটু সময় লাগে। সেটুকু অপেক্ষা করে বিলকিস।
তারপর জিগ্যেস করে, কী হয়েছিল?
অনেকগুলো ছেলে। বাজারে দাঁড় করায়। এক সঙ্গে গুলি করেছিল।
খোকা ছিল?
হাঁ।
তুমি কখন জানলে?
তখন খোঁজ নিতে বেরুলাম। মোক্তার সাহেবের কাছে শুনলাম।
খোকার নাম করে বললেন?
না, বললেন, অনেকে ছিল, মফিজ, নান্টু, এরফান, চুনি মার্চেন্টের ছোট শালা, তারপর বললেন কাদের মাস্টারের ছেলে। বাজার করতে এসেছিল কিছু লোক, মারা গেছে, কয়েকজন দোকানদার, কয়েকটা বাচ্চা ছেলেও আছে।