আপনিও তো না খেয়ে আপা!
নিঃশব্দে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ওরা। পথের ওপর দাঁড়িয়ে সিরাজ একবার সামনে পেছনে দেখে নেয়। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে না।
ফিসফিস করে বলে, কেউ নেই। তবু সাবধান থাকা ভালো। পথ ছেড়ে এদিক আসুন।
বাড়িগুলোর ধার ঘেষে, ড্রেনের পাড় দিয়ে দ্রুত সন্তৰ্পণে হেঁটে চলে ওরা।
রেললাইন পার হয়ে কাঠের গুদামগুলো পড়ে। বড় বড় গাছ কান্ত হয়ে আছে। কিছু চেরাই হয়েছে। কাঠের সোদা গন্ধে বাতাস মম করছে। বিলকিসের মনে পড়ে যায়, ছোটবেলায় এখানে এসে হাঁ করে সে কাঠ চেরাই দেখত। প্রতিদিনই চোখে কাঠের গুড়ো পড়ত। চোখ লাল হয়ে যেত।
গন্তব্য ঠিক বুঝতে পারে না বিলকিস।
এর পরেই তো সিনেমা হলের রাস্তা!
হাঁ। আপনার মনে আছে?
কেন মনে থাকবে না?
ফিসফিস করে কথা বললেও সিরাজ এখন নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে কথা না বলবার ইশারা দেয়।
গন্তব্য আর জিগ্যেস করা হয় না।
কখনো থেমে চারদিকে দেখে নিয়ে, কখনো দ্রুত পায়ে খোলা একটা জায়গা পার হয়ে ঝোঁপের সমান মাথা নিচু করে নিঃশব্দে এগিয়ে চলে সিরাজ। বিলকিস তার অনুসরণ করে।
অচিরে একটা পাড়ায় এসে ঢোকে তারা।
কথা বলবার নিষেধ সত্ত্বেও বিলকিস না বলে পারে না, মোক্তার পাড়া না?
হাঁ। প্ৰায় এসে গেছি।
একটা বাড়ির সমুখে এসে সিরাজ দ্রুত একবার দেখে নেয় চারদিক। তারপর হঠাৎ বিলকিসের হাত ধরে একটা চালার পেছনে টেনে নিয়ে যায়।
জলেশ্বরীতে এই প্রথম মানুষের সাড়া পায় বিলকিস।
দূরে, কাঁকর বিছানো বড় সড়কের ওপর পায়ের শব্দ। কে যেন ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে! চালার পেছন থেকে বেরিয়ে এসে কাঁঠাল গাছের নিচ দিয়ে একটা বাড়ির ভেতরে ঢোকে দুজনে।
প্রশস্ত আঙ্গিনা ভেতরে। অন্ধকারও অনেকটা তরল। আঙ্গিনা জুড়ে শুকনো পাতার ছড়াছড়ি। বঁট দিকে তিনটি কাঁঠাল গাছ ঘিরে বেড়া চলে গেছে। ডান দিকে বড় একটা টিনের ঘর। সমুখে শেষ মাথায় রান্নার চালা। তার পাশে স্তুপ করে খড়ের গাদা, গরুর গোয়াল। গোয়ালটা শূন্য।
বাড়িটাকেও জনশূন্য মনে হয়।
কেউ নেই বাড়িতে?
ফিসফিস করে সিরাজ বলে, আছে।
বিলকিস অবাক হয়। আঙ্গিনা দেখে তার মনে হয়েছিল, কতকাল মানুষ এখানে বাস করে নি।
বিলকিস নিঃশব্দে দাঁড়াবার ইশারা করে বেড়ালের মতো লঘু পায়ে সিরাজ টিনের ঘরের বারান্দায় উঠে যায়। তখন চোখে পড়ে বিলকিসের, বারান্দায় জলচৌকির ওপর স্থির বসে থাকা একটা মানুষের আদল। তার সঙ্গে কথা হয় সিরাজের। তারপর সে বারান্দার কিনারে এসে ইশারায় বিলকিসকে কাছে ডাকে।
কাছে আসতেই সিরাজ লোকটিকে বলে, কাদের মাস্টারের মেয়ে।
লোকটি প্রাণহীন মূর্তির মতো সমুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। কথাটা শুনেছে কি শোনে নি, বিন্দুমাত্র বোঝা যায় না। লোকটির দৃষ্টি আঙ্গিনার দিকে স্থির নিবদ্ধ।
সিরাজ চাপা গলায় বলে, ইনি আলেফ মোক্তার। এখন চোখে দেখতে পান না।
অস্ফুট কাতর ধ্বনি করে ওঠে বিলকিস। এককালের জাঁদরেল মোক্তার বলে খ্যাতি ছিল তার। বৃটিশ আমলে মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতা ছিলেন। বিলকিসের এখনো মনে আছে, ভোটে জেতার পর, তার গলায় ফুলের মালা দিয়ে জলেশ্বরীতে মিছিল বেরিয়েছিল। পাকিস্তান হবার বছরের বালিকা বিদ্যালয় ঈদ পুনর্মিলনীতে আবৃত্তি করে বিলকিস ফার্স্ট হয়েছিল। পুরস্কার হাতে তুলে দিয়েছিলেন আলেফ মোক্তার। তারপর, চুয়ান্ন সালের ভোটে যখন নবগ্রামের কাশেম মিয়ার কাছে তিনি হেরে যান তখন, বিলকিসের মনে পড়ে, মা গঞ্জনা দিচ্ছিলেন বাবাকে-কই ছাত্রের জন্যে তোমার না। এত গর্ব! তোমার ছাত্ৰই তো এখন জিতেছে। মনখারাপ করছ কেন? এতকালের বন্ধুর জন্যে মন খারাপ না করে কাশেমের জন্যে লাফাও! দেখি ছাত্রের দিকে তোমার কত টান?
বাবার সেই অপ্রস্তুত মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পায় বিলকিস।
এই সেই আলেফ মোক্তার!
পাতা ঝরা আঙ্গিনার দিকে তিনি স্থির তাকিয়ে থাকেন কিংবা চোখ হারিয়ে ফেলবার পরও তাকিয়ে থাকার অভ্যোস মানুষের যায় না।
ঠিক কী বলবে বুঝতে পারে না বিলকিস।
উনি ঐ রকমই বসে থাকেন। সারা দিন-রাত।
ঘরের ভেতরে সেকালের ভারি দুটো আলমারি, অতি প্রশস্ত একটি খাট, অন্ধকারেও বার্নিশের কোথাও কোথাও আলোর বিন্দু ধরা পড়ে আছে। আর একটা ভ্যাপসা গন্ধ, কাপড় ভিজে ভালো করে না শুকোবার মতো তীব্ৰ ঘ্রাণ।
বাড়িতে আর কেউ নেই?
না!
বৌ, ছেলে, মেয়ে?
এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিল নেভির এক লোকের সঙ্গে, কোথায় আছে জানি না। বাকি দুই ছেলে, দুজনেই পাবনায়। একটু থেমে সিরাজ যোগ করে, মানসিক হাসপাতালে। একটু দাঁড়ান তো আপা।
সিরাজ বাইরে যায়। অনুচ্চ স্বরে আলেফ মোক্তারের সঙ্গে কী কথা বলে। আবার ফিরে আসে ঘরে।
বিলকিস জিগ্যেস করে, বৌ?
বলতে পারব না কেন, বৌ তার বাপের বাড়িতেই অনেকদিন থেকে আছে। চোখ একেবায়েই নষ্ট হয়ে গেল প্ৰায় সেই থেকেই।
আসে না?
কী জানি! অনেকদিন দেখি নি।
উনি এভাবে থাকেন, দেখে কে? রান্না খাওয়া?
ওর পুরনো মুহুরি, সে-ই দেখাশোনা করত। গণ্ডগোলের সময় সে পালিয়েছে।
এখন?
সিরাজ চুপ করে থাকে।
এখন কে দেখে?
আপা, এখন কে কাকে দেখবে?
সিরাজের এই নিষ্ঠুর উত্তর শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায় বিলকিস! একটা মানুষ, অন্ধ, বয়স প্রায় সত্তর, তাকে কেউ দেখছে কিনা, সে প্রশ্নে এতটা তাচ্ছিল্য আশা করা যায় না। অন্তত সিরাজের কাছ থেকে, যে বিলকিসকে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে নবগ্রাম থেকে এ পর্যন্ত সঙ্গ দিয়েছে এবং কেবল এই আশংকায় যে বিলকিসের কোনো ক্ষতি বা বিপদ হতে পারে।