তারপর শমশের এসে বলে, ভাবি, ঢাকায় এখন শুরু হয়ে গেছে। শোনেন নি। পরশু দিন গুলির শব্দ? ফার্মগেটে? আমাদের ছেলেরা হামলা করেছিল।
শমশেরের সন্দেহ, মিলিটারি এখন তৎপর হয়ে যাবে, খুঁজে বের করবে, কোন বাড়ির সঙ্গে ইন্ডিয়ার যোগাযোগ আছে। আলতাফ যদি ইন্ডিয়ায় গিয়ে থাকে, তাহলে মিলিটারি একদিন বিলকিসকেই ধরবে।
আমার মনে হয়, আপনি দেশের বাড়িতে চলে যান ভাবি।
আলতাফ কি ইন্ডিয়ায় গেছে? যদি এমন হয়, যুদ্ধে যোগ দিয়েছে সে? এই যে শোনা যায়, ছেলেরা এখানে পুল উড়িয়ে দিয়েছে, ওখানে গ্রেনেড ছুঁড়েছে, এক গাড়ি সৈন্য খতম করেছে–যদি তার কোনো একটি আলতাফের কাজ হয়? ঢাকায় রাতে যে প্রায়ই গুলির শব্দ শোনা যায়, তার সবই কি মিলিটারির? কোনো একটি কি আলতাফের নয়?
বিলকিস একই সঙ্গে বুকের ভেতরে মঙ্গল কামনায় কাপন এবং প্রতিরোধের গৌরব অনুভব করে।
যদি গত বছরও তারা নিষেধ তুলে নিত তাহলে আজ তার কোলে থাকত সন্তান। আলতাফের।
বুকের ভেতরে হঠাৎ ক্ষোভ জমে ওঠে। বিয়ের পর তো পাঁচ বছর গেছে! এবার একটি ছেলে হবার কথা ভাবা উচিত ছিল তাদের।
ছেলে হলে, এখন এই পরিস্থিতিতে মুশকিল হতো। না হয়েছে, ভালোই হয়েছে।
কিন্তু আলতাফ যদি আর ফিরে না আসে! যদি সে রাতেই তার মৃত্যু হয়ে থাকে। আলতাফ . কি ইচ্ছে করে নীরব থাকবে? আলতাফ কি তাকে ভালোবাসে না? বিলকিস কি তাকে ভালোবাসা দেয় নি?
আপা।
চমকে ওঠে বিলকিস। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক বুঝতে পারে না, সত্যি কি মানুষের স্বর? না তার কল্পনা?
অন্ধকার ফুঁড়ে সিরাজ দেখা দেয়। আপা, আমি। চারদিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয় সে। কেউ এসেছিল?
না। আমি ঠিক ছিলাম। কিছু শুনলে?
হুঁ।
কী?
খালের পুলটা ঠিক ভাঙতে পারে নি। একদিকের রেলটা গেছে।
পুলের কথা নয়, মা ভাইবোনের কথা শুনতে চায় বিলকিস। কিন্তু সাহস করে জিগ্যেস করতে পারে না। উদ্বিগ্ন চোখে অন্ধকারের ভেতর সিরাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোথা থেকে একটা ফোঁটা আলো এসে সিরাজের চোখ দুটিকে স্পষ্ট করে তুলেছে। মনে হয়, ছলছল করছে।
সিরাজ বলে, আর যা শুনলাম, আপনার সকলেই ভালো আছে।
কার কাছে শুনলে? কোথায় আছে ওরা?
নদীর ওপারে, বিশেষ করে টাওনের এ দিকটার সবাই আজ দুপুরে বেরিয়ে যায়। আপনার সকলকেই দেখা গেছে। ওদিকের কেউ বিশেষ সরতে পারে নি। ওদিকে বিহারীদের বাড়ি অনেকগুলো। মিলিটারি ওদের বন্দুক দিয়েছে।
সিরাজ প্রায় মুখস্থের মতো না থেমে বলে যায়। এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ করা যায়, যেন বক্তব্য শেষ করতে পারলেই নিষ্কৃতি পায় সে।
বিলকিস সেটা লক্ষ করে। হয়তো, একাকী বাইরে বিপদের মধ্যে ঘুরে আসবার উত্তেজনায় সিরাজের গলার স্বরও পাল্টে গেছে।
আপনি কী করছিলেন এতক্ষণ? আমার একটু দেরিই হয়ে গেল।
বসে ছিলাম।
ভয় পান নি তো?
বিলকিস ছোট্ট করে মাথা নাড়ে। ভয়ের অনুভূতিটাই তখন তার কাছে অচেনা বলে বোধ হয়।
তুমি সত্যি শুনেছি, ওরা নদীর ওপারে গেছে?
হাঁ, এখানকার কয়েকজন ছেলে, বাড়ি বাড়ি এসে মেয়েদের তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে আসতে বলে। ওরাই সকলকে নদীর ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যায়।
শুধু মেয়েদের উল্লেখ শুনে বিলকিস বিচলিত হয়ে পড়ে।
আর খোকা?
আপনার ভাই?
হাঁ, খোকা সঙ্গে যায় নি?
সবাই গিয়েছে। আপনার কিছু ভাবতে হবে না। রাতে ঠিক সুবিধে হবে না। কাল দিনের বেলায় দেখি, আপনাকে ওপারে দিয়ে আসা যায় কি না।
তুমি যে বললে, রাতে মিলিটারি থাকে না, দিনে অসুবিধে হবে না?
আপনি একটা ছেড়া শাড়ি পরে নেবেন। দেখে যেন চাষীদের বাড়ির মনে হয়।
তুমি ভাই অনেক করলে আমার জন্যে। বিলকিস তার হাত ধরে বলে। সিরাজের ভেতরে কোথায় যেন সে খোকাকে দেখতে পায়। কখনো কখনো সমস্ত মানুষের মুখ এক হয়ে যায়। এখন এমনি একটা সময়।
দ্রুত কণ্ঠে সিরাজ বলে, আপনার তো কিছু খাওয়া হয় নি!
না, না, আমার খিদে পায় নি। তোমার?
দিদি, আপা, সামনে পুরো একটা রাত। না খেয়ে থাকবেন? রান্নাঘরে কিছু নেই?
দাঁড়াও বাতি জ্বালি।
না। বাতি জ্বালাবেন না।
একটু আগে লণ্ঠন ধরিয়েছিল বিলকিস। সেটা মনে করে বুক চমকে ওঠে এখন।
আসলে, আপা, এখানে থাকা আর ঠিক হবে না।
কেন?, এ পাড়ায় কেউ নেই। বিহারীরা জানে। লুট করতে আসতে পারে। ওদের তো এখন রাজত্ব।
তাহলে?
আসুন আগে রান্নাঘরে যাই। মুড়িটুড়ি কিছু থাকলে নিয়ে চলুন বেরোই।
কোথায়?
যেখানে হোক। এখানে না, আপা। এখানে আজ রাতে ভয় আছে, আমি শুনে এসেছি।
বলতে গিয়ে সিরাজের গলাও কেঁপে যায়।
বিলকিসই তাকে সাহস দেয়; সে সাহস মুখের নয়, অন্তরের ভেতর থেকে বোধ করে সাহস।
ভয় পেও না। ঢাকায় এ কমাস একা একটা বাড়িতে থেকেছি।
কিন্তু এখান থেকে আমাদের যেতেই হবে।
যাব। আগে দেখি রান্নাঘরে কিছু আছে কিনা। লণ্ঠন জুলি। একটু আগেও জ্বেলেছিলাম।
০৪. বিলকিস
রান্নাঘরে কিছুই পাওয়া যায় না। চাল আছে, কিন্তু রান্না করতে হবে।
সিরাজ তাড়া দেয়–থাক। মুড়ি বোধহয় ওরা যাবার সময় নিয়ে গেছেন।
হাঁ, সঙ্গে বাচ্চারা আছে।
বিধবা বোনের শিশু দুটির মুখ ক্ষণকালের জন্যে বিলকিসের চোখের ভেতরে খেলা করে। ঘরের ভেতরে একবার দেখে নেবেন নাকি?
কী দেখব?
দামি কিছু ফেলে গিয়ে থাকলে না হয়। সঙ্গে নেওয়া যেত।
কী আর সঙ্গে নেব সিরাজ? কত কিছুই তো ফেলে দিতে হলো।
ফুঁ দিয়ে লণ্ঠন নিভিয়ে দেয় সিরাজ।
তোমার কিছু খাওয়া জুটল না।