সিরাজ হাসে।
বাহাদুরি কোরো না।
আপনি জানেন না দিদি, মিলিটারি সন্ধের পর বেরোয় না। ওদের সব দিনের বেলায়।
হাত ছেড়ে দেয় বিলকিস।
আপনি একা থাকতে পারবেন তো? আমি বেশি দেরি করব না।
সিরাজ বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে।
আপনি বারান্দাতেই বসবেন?
কেন?
সদর দরোজায় কেউ দাঁড়ালে সোজা দেখা যায়। দরোজা বন্ধ করে যেতে চাই না। কেউ হয়তো সন্দেহ করবে। ভেতরে লোক আছে। কী হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না তো। আপনি বরং রান্নাঘরের ওদিকটায় থাকুন, আমার গলা না পাওয়া পর্যন্ত সাড়া দেবেন না, কোনো শব্দ হলেও বেরুবেন না। আমি এসে আপনাকে ডাকব।
সিরাজ নিঃশব্দ পায়ে অন্ধকারের ভেতর মিলিয়ে যায়। তার চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার যেন রোয়া ফুলিয়ে বিশাল আকার ধারণ করে। রান্নাঘরের পাশে কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে গা ছমছম করে ওঠে বিলকিসের। সেখান থেকে দ্রুত পায়ে সে সরে আসে।
রান্নাঘরের পেছনের বেড়ার ওপারে পাশের বাড়ি। বেড়ার ফাঁক দিয়ে তার আঙিনা দেখা যায় দিনের বেলায়। মা অনেক সময় বেড়া ফাঁক করে পাশের বাড়ির বৌয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। সাইকেলের দোকান আছে। ওদের; স্বামীটি হাঁপানিতে ভোগে। যখন টান ওঠে, এ বাড়িতে সারা রাত ঘুমানো যায় না তার শ্বাস নেবার আর্তিতে।
এখন সে বাড়ি নিঃস্তব্ধ। বেড়া ফাঁক করে দেখে সে। কঠিন অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। কান খাড়া করে। মানুষের উপস্থিতির কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
বিলকিসের মনে হয়, রান্না ঘরের দরোজায় কে এসে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তে সে ঘুরে তাকায়। কেউ না। কেউ যদি এসে দাঁড়াত তার পালাবার পথ থাকত না। লাফ দিয়ে সে ঘর থেকে বেরোয়। উঠানের কাপড়গুলো ছয়ে দেখে। শুকিয়ে খটখটি হয়ে আছে। একটা শার্ট, বাচ্চাদের কয়েকটা জামা, গামছা, দুটো শাদা শাড়ি। মৃদু বাতাসে শাড়ির ভাঁজ করা পেট ফুলে ফুলে ওঠে। আবার ঝুলে পড়ে অনবরত পতাকার মতো সখেদে কাপে। একটা শাড়ির কোণ হাতের মুঠোয় নিয়ে বিলকিস তার মুখে চেপে ধরে। সাবান দিয়ে ধোবার পরও মানুষের সুবাস এখনো যায় নি। সে তার মায়ের বোনের উপস্থিতি অনুভব করে। ওদের কি মেরে ফেলেছে?
তাহলে লাশ গেল কোথায়? তাহলে তো রক্তের দাগ থাকত। অন্ধকারে হয়তো রক্তের দাগ চোখে পড়ে নি। বাতি জ্বালালেই দেখতে পাবে। জ্বালাবে সে বাতি? নিশ্চয়ই রান্নাঘরে ছেলেবেলা থেকে পরিচিত পূর্বদিকের তাকে কুপি লণ্ঠন সাজানো আছে। পাশে রাখা আছে দেশলাই।
রান্নাঘরে সে আবার আসে। অতি পরিচিত ঘরে তাকে হাতড়াতে হয় না। ঠিক পৌঁছে যায় তাকের কাছে। হাত দিয়ে অনুভব করে দুটো কুপি, একটা লণ্ঠন। পাশে খড়মড় ওঠে দোলাইয়ের বাক্স।
সন্তৰ্পণে সে লণ্ঠন নামায়।
সিরাজ সাবধান করে গিয়েছিল, কেউ যেন টের না পায় বাড়িতে মানুষ আছে। বাতি জ্বালালে যদি কারো চোখে পড়ে? কিন্তু মিলিটারি তো রাতে বেরোয় না। চোখে পড়বে। কার? লণ্ঠনের চিমনি তুলে ধরে বিলকিস। ফস করে দেশলাই জ্বালিয়ে কাঠিটা ধরে রেখে সে কান খাড়া করে, পেছনে তাকিয়ে দ্যাখে। তারপর সলতে ধরিয়ে খুব ছোট করে দেয়।
সেই অল্প আলোতেও চোখে পড়ে–নিভে যাওয়া উনোনের ওপর খোলা কড়াই। রান্না শেষ হবার আগেই চলে যেতে হয়েছে। ঘরের এক কোণে হয়তো চাল বাছা হচ্ছিল, কুলোর ওপর এখনো কিছু চাল। মেঝের ওপর একটা থালায় দুখানা আটার রুটি, আধা-খাওয়া কলা। লণ্ঠনটা আঁচলে ঢেকে সে দ্রুত পায়ে শোবার ঘরে যায় প্ৰথমে। কী জানি কেন, এখন আর তার তেমন ভয় করে না। এমন একেকটা মুহূর্ত আসে, মানুষ যখন বাস্তব থেকে উন্নীত হয়ে যায়।
ঘরের ভেতরে সে প্ৰথমেই মেঝের ওপর সন্ধান করে। কোথাও কি রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে?
খাট দেখে, দেয়াল দেখে, পাশে পার্টিশন করা তার ছোট ভাইয়ের ঘর। খোকা কি রংপুরে ছিল? না, বাড়িতেই ছিল? বিছানা ব্যবহার করা মনে হয়। হয়তো খোকা কলেজে আর ফিরে যায় নি। জলেশ্বরীতেই বসে ছিল। খোকার জন্যে হঠাৎ বুকের ভেতরে মুহূর্তে কাঁপন ওঠে তার।
এই বয়সের ছেলেদেরই তো ওরা মেরে ফেলে।
সিরাজের কথা এতক্ষণ সে ভুলেই গিয়েছিল।
উদ্বিগ্ন হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসে সে। কতক্ষণ হয়ে গেছে, সিরাজ এখনো ফিরছে না কেন?
বাড়ির সকলে গেছে কোথায়? কখন গেছে? মেরে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে না তার সব দেখেশুনে। কিন্তু হঠাৎ এমন করে চলে যেতে হলো কেন? একবার তো নদীর ওপারে চলে গিয়েছিল, আবারো কি সেখানেই গেছে?
লণ্ঠন নিভিয়ে, চেয়ারটাকে কোনো শব্দ না করে টেনে এনে বারান্দার শেষ প্রান্তে রাখে। বিলকিস। এখান থেকে সদর দরোজা চোখে পড়ে না। সে বসে।
এই প্রথম তার সারা পা টিনটিন করে ওঠে। পাঁচ মাইল হাঁটার ক্লান্তি অনুভব করে সে। ব্যথাটা আস্তে আস্তে পা থেকে সারা পিঠে ছড়িয়ে পড়ে তার। বড় পিপাসা পায়। পেটের ভেতরে পাকিয়ে ওঠে। সারা দিন কিছু পেটে পড়ে নি। ব্যথার সঙ্গে এখন যুক্ত হয় ক্ষুধার যন্ত্রণা।
মাথার ভেতরটা ভয়াবহ রকমে শূন্য মনে হয়।
আলতাফ ফিরে আসবে সে আর আশা করে না। তবু ঢাকায় ছিল, যদি কখনো কোনো খবর পাওয়া যায়। যদি এমন হয় যে, সে ঘুমিয়ে আছে, দরোজায় সাবধানী করাঘাত, দরজা খুলতেই আলতাফ।
হাতের টাকা সব শেষ হয়ে আসে। বাড়ি ভাড়া দুমাসের বাকি পড়ে। বাড়িওয়ালাকে আজকাল আর চেনা যায় না। এখন সে দাড়ি রেখে দিয়েছে, মাথা থেকে টুপি নামে না। সে এসে ভাড়ার জন্যে যত না চাপ দেয়, তার চেয়ে বেশি করে পরামর্শ দেয়–দেশের বাড়িতে চলে যান, এখানে একা থাকা তো ভালো মনে করি না।