মায়ের মুখ চোখের সমুখে ভেসে ওঠে বিলকিসের।
হাই স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টারের চেয়ে বেশি কিছু হতে পারেন নি বাবা, মা পদে পদে গঞ্জনা দিতেন তাকে। বাবা বলতেন, আমি না হই, আমার ছাত্ররা তো হয়েছে।
জলেশ্বরীতে আজ ভোরের ঘটনার পর মা, ভাই বোন ভালো আছে তো? বিলকিস বড় বিচলিত বোধ করে।
সিরাজ, সত্যি দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বিলকিস স্লিপারের ওপর পা রাখে। তারপর শাড়ি একটু তুলে, হাতে গুটিয়ে নিয়ে, লম্বা পা ফেলে ডিঙোতে থাকে। প্রথমে একটু বেসামাল ঠেকে, অচিরে অভ্যোস হয়ে যায়।
আর কতদূর, সিরাজ?
আপনি হাঁপিয়ে গেছেন?
না, না।
একটু দাঁড়িয়ে যান, না হয়?
না দেরি হয়ে যাবে। মন কেমন করছে। বাড়ির কথা ভেবে কিছু ভালো লাগছে না, সিরাজ।
মাস্টার বাড়িতে কেউ কিছু করবে না।
ঢাকার কথা তুমি জান না। ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের বাড়িতে ঢুকে গুলি করে মেরেছে। হিন্দু প্রফেসরদের বেনোয়েট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে।
সিরাজ শিউরে ওঠে।
তুমি শোন নি?
সিরাজ ভয়ার্ত চোখে ম্লান হাসে।
আর কতদূর আছে আমাকে বল।
মাইল দুয়েক।
তুমি না হয় ফিরে যাও, সিরাজ। তোমার জন্যেই এখন আমার ভয় করছে। তুমি জান না, তোমার বয়সী ছেলেদেরই মিলিটারি ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ইনজেকশন দিয়ে সব রক্ত টেনে নেয় ওরা, হাত বাধা অনেক লাশ পাওয়া গেছে, নদীতে ভেসে আছে, তোমার বয়সী সব। তুমি ফিরে যাও, আমি ঠিক যেতে পারব।
সিরাজ দাঁড়িয়ে পড়ে। হয়তো সে মনের ভেতর অনুরোধটি নিয়ে নাড়াচাড়া করে, বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কেবল তাকে মূর্তির মতো স্থির দেখায়।
তারপর সে নীরবেই আবার চলতে শুরু করে। যেন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, ফিরে যাবে না। তুমি অদ্ভুত ছেলে তো!
সিরাজ উত্তর দেয় না।
০৩. সিরাজ
সন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই ওরা জলেশ্বরীর ভেতরে পা রাখে। তিন সড়কের মোড়ে ডাকবাংলা থেকেই সীমানা ধরা হয়। কিন্তু সড়ক ধরে আসে নি। তার আগে ছিল সেই খাল, যে খালের পুলের ওপর সকালে ডিনামাইট ফেটেছিল। সে জায়গাটা ঘুরে, বনের ভেতর দিয়ে ওরা কবরস্থানের পাশ দিয়ে আবার রেললাইনের ওপর জলেশ্বরীর ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছে এসে দাঁড়ায়।
কোথাও কোনো শব্দ নেই। এমনকি দূরে যে দুএকটা ঘর চোখে পড়ে তাতেও কোনো বাতি নেই।
এতক্ষণ ফসলের মাঠে যে স্তদ্ধতা ছিল, তা থেকে শহরের এই স্তব্ধতা একেবারে আলাদা। এখানে টের পাওয়া যায় মানুষ আছে, কিন্তু নিঃশ্বাস পতনের শব্দ নেই। শব্দের সম্ভাবনা আছে কিন্তু শব্দ নেই।
বিলকিস উদ্বিগ্ন চোখে সিরাজের দিকে তাকায়।
সিরাজ গুম হয়ে থাকে।
রেললাইন ধরে গেলেই বিলকিসের বাড়ি সংক্ষিপ্ত পথে পৌঁছুনো যায়। সেই পথেই এগোয় তারা। কান খাড়া করে রাখে। কিন্তু কিছুই টের পাওয়া যায় না।
দ্রুত পায়ে ওরা দুজনে চলে। আর কিছুদূর গেলেই ছোট একটা সড়ক লাইনটাকে কাটাকুটি করে গেছে। তার বাঁ হাতিতে কয়েক পা দূরেই কাদের মাস্টারের বাড়ি।
অন্ধকারের ভেতরেও দূর থেকে চোখে পড়ে লম্বা ঘরের পেছনে টক আমের গাছটি।
শেষ কয়েক হাত বিলকিস দৌড়ে যায় বাড়ির দিকে।
বাড়ির সদর দরোজায়। থমকে দাঁড়ায় সে। সিরাজ এসে যায়।
সিরাজ বলে, বাড়িতে কেউ নেই মনে হয়।
সদর দরোজায় পা দিয়েই রক্তের ভেতরে সেটা টের পেয়েছিল। দরোজা হয় খোলা। ভেতরে জমাট অন্ধকার।
ক্রস্ত পায়ে দুজনে ঢোকে। অন্তত বাইরের চেয়ে নিরাপদ। অন্ধকারের ভেতরেই চোখে পড়ে বাড়ির কিছু কাপড় ঝুলছে, বারান্দায় বালতিতে রাখা পানি, বদনা। রান্নাঘরে মেঝের ওপর ইতস্তত ছড়িয়ে আছে বাসনকোসন যেন এইমাত্র কেউ খেতে খেতে উঠে গেছে। দাওয়ার নির্টে পড়ে আছে শাদা-কালো খোপ কাটা ফুটবল।
শোবার ঘরের বারান্দায় কাঠের পুরনো যে চেয়ারটাতে কাদের মাস্টার বসতেন, সেই চেয়ারটা এখনো আছে। সারা বাড়িতে চেয়ারের এই শূন্যতা আরো বিকট মনে হয়।
সমস্ত ঘরগুলো দৌড়ে এসে বিলকিস চেয়ারের পিঠ ধরে দাঁড়ায়।
কোথায় গেল সব?
বুঝতে পারছি না। পাশের কোনো বাড়ি থেকেও আওয়াজ পাচ্ছি না।
কী হবে, সিরাজ?
আপনি একটু বসুন।
বিলকিস। তবু চেয়ারের পিঠ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
আপনি বসুন তো। এতটা পথ হেঁটে এসেছেন।
প্ৰায় জোর করে সে চেয়ারে বসিয়ে দেয় বিলকিসকে। যে ছেলেটিকে সারা বিকেল সদ্য কৈশোর পেরুনো অপ্ৰতিভা তরুণ বলে মনে হচ্ছিল, এখন তাকে অন্য রকম মনে হয়। একটি সন্ধেয় সে অনেকগুলো বৎসর পেরিয়ে এসেছে। তার গলায় নিশ্চয়তা এসেছে, চিন্তায় তৎপরতা।
আপনি বসুন। উতলা হবেন না।
সিরাজ নিজে এবার সারা বাড়ি ঘুরে আসে। প্রতিটি ঘরের ভেতর উঁকি দেয়। তারপর সদর দরোজা দিয়ে বাইরে যায়। আবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসে।
পাশের কোনো বাড়িতেও মানুষ নেই। মনে হয়, পালিয়েছে।
তার চেয়ে অন্য কিছু তো হতে পারে? মানুষগুলো খুন হতে পারে। বিলকিসের চোখে সেই উদ্বেগ ফুটে বেরোয়। সে আর বসে থাকতে পারে না। উঠে দাঁড়ায়।
তাহলে?
আপা, আপনি বসুন।
আবার তাকে চেয়ারে বসিয়ে দেয় সিরাজ। কিছুক্ষণ পরে কী চিন্তা করে বলে, আপনি একা থাকতে পারবেন? আধা ঘণ্টা?
তুমি কোথায় যাবে?
দেখি যদি খবর পাওয়া যায়।
তার হাত ধরে বিলকিস। না, তুমি বেরিও না।
আমার কিছু হবে না।
কোথায় খবর পাবে? কে আছে?
দেখি না, ইস্টিশানের পাশে কয়েকটা দোকান আছে, বাসা আছে, তারা হয়তো কিছু বলতে পারবে।
অত দূরে যাবে? যদি তোমাকে ধরে?