ছেলেটি এখনো ফিরে যায় নি দেখে বিলকিস কৃতজ্ঞ বোধ করে। মনে মনে সে আশা করে, আরো কিছুদূর তার সঙ্গে আসবে ছেলেটি। এই মুহূর্তে একটা সেতু রচনার প্রয়োজন সে অনুভব করে। বলে, ছেলেটির বোনের কথা মনে রেখে, মিলিটারি?
হাঁ তারপর, ওরা ওকে মেরে ফেলে।
তারপর? কীসের পর? কিন্তু সে প্রশ্ন চিন্তায় আসা মাত্র শিউরে ওঠে বিলকিস।
ছেলেটি বিলকিসের হাত থেকে নীরবে সুটকেসটা এবার নেয়। বলে, আপনি যাবেনই?
এতখানি এসে ঢাকায় ফিরে যাব?
তা ঠিক।
তোমার বোন কোথায় ছিল?
জলেশ্বরীতে।
বিয়ে হয়েছিল?
হবার কথা ছিল। সব ঠিক হয়ে ছিল। তারপর এই সব হয়ে গেল।
বিলকিস ঠিক বুঝতে পারে না, অবিবাহিত বোন ছিল জলেশ্বরীতে, ছেলেটি নবগ্রামে, ওদের বাড়ি কোথায়–নবগ্রামে, না জলেশ্বরীতে?
মানুষ অনেক সময় প্রশ্ন উচ্চারণের আগেই উত্তর পেয়ে যায়। ছেলেটি বলে, আমার বাবা মা ছোট ভাই, সবাই এক রাতে বিহারীদের হাতে খুন হয়। আমি ইন্ডিয়া চলে যেতাম, আমার এক বন্ধু নবগ্রামের, সে আমাকে জলেশ্বরী থেকে এখানে নিয়ে আসে। একা যেতে সাহস পাই নি।
বোঝা যায় ছেলেটি আসলে জলেশ্বরীর। বিলকিস আরো অনুভব করে, ছেলেটি তাকে বিশ্বাস করে। নইলে ইন্ডিয়া চলে যাবার কথা বলতে পারত না। তার একটু কৌতূহল হয়, ছেলেটি অচেনা একজনকে এতটা বিশ্বাস করতে পারছে কী করে?
অনেকখানি চলে এসেছে তারা, আবার রেললাইনের দুধারে জঙ্গল চেপে আসছে। দূরে সুড়ঙ্গের মতো দেখাচ্ছে জঙ্গলের ভেতরে পথটুকু।
বিলকিস জিগ্যেস করে, তুমি আর কতদূর আসবে? চলুন না দেখি।
তোমার ভয় করে না?
কীসের ভয়?
জলেশ্বরীতে আজ নাকি মিলিটারি গুলি করেছে?
শুনেছি।
ওরা যদি তোমাকে ধরে?
আমি তো পথঘাট চিনি। আপনি তো তাও চেনেন না।
আমার জন্যে বিপদে পড়বে কেন?
ছেলেটি এ প্রশ্নের উত্তর দেয় না। তাকে লজ্জিত এবং অপ্রস্তুত দেখায়।
তার চেয়ে তুমি ফিরে যাও।
দুজন এক সঙ্গে থাকলে ভয় নেই।
তারপর নবগ্রামে ফিরে আসবে কী করে? রাত হয়ে যাবে না?
আপনাদের বাড়িতে যদি থাকতে দেন।
তুমি চেনো আমাদের বাড়ি?
ছেলেটি উৎসাহের সঙ্গে বলে, কেন চিনব না? আপনি তো কাদের মাস্টারের—
আমার বাবাকে তুমি দেখেছ?
দেখেছি, খুব ভালো মনে নেই। যেবার আমি মাইনর স্কুল থেকে হাই স্কুলে গেলাম, উনি তার আগেই মারা গেলেন তো! ওঁর কাছে যদি ইংরেজি শিখতে পারতাম!
কেন?
সকলেই বলে, কাদের মাস্টারের মতো ইংরেজি কেউ জানে না।
সবুজ সুড়ঙ্গের ভেতর এখন ঢুকে যায় ওরা। ভারি শীতল লাগে। বুনো ঝোঁপের পাতাগুলো সজল ঝকঝাক করে। পায়ে চলা সরু পথটা এখানে হারিয়ে গেছে বলে দুজনের লাইনের ওপর উঠে আসতে হয়।
তোমরা থাক কোথায়?
প্রশ্ন করেই বিলকিসের মনে পড়ে যায়, এখন তো ছেলেটির কেউই বেঁচে নেই। বাড়ির কথা মনে করিয়ে দেওয়াতে সে অপরাধ বোধ করতে থাকে। বিষণ্ণ হয়ে যায়।
ছেলেটি ইতস্তত করে বলে, পোস্টাপিসের পেছনে জলার ঐ পারে।
বিশদ জিগ্যেস করে আর তাকে কষ্ট দিতে চায় না বিলকিস। অপ্রত্যাশিতভাবে জুটে যাওয়া তরুণ এই সঙ্গীটির অদেখা বাবা, মা, বোনের কথা সে ভাবে।
পথ চলে। তার নিজের কথা মনে পড়ে যায়। আলতাফ কি বেঁচে আছে? যে খবরের কাগজে। আলতাফ কাজ করত, পচিশে মার্চ রাতে মিলিটারি সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাতের শিফটে ছিল আলতাফ। সে আর ফেরে নি। যে দুটি লাশ পাওয়া গেছে, আলতাফের বলে সনাক্ত করা যায় নি। আলতাফের বন্ধু এক সাংবাদিক, অন্য কাগজের শমশের, সে কয়েকবার বলেছে–ভাবি, আমি আপনাকে জোর দিয়ে বলতে পারি। আলতাফ বেঁচে আছে।
তাহলে সে ফিরল না কেন? প্ৰতিদিন বিলকিস রাতের অন্ধকারে কানের কাছে রেডিও নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনেছে। প্রতি রাতে সে আশা করেছে। হয়তো আলতাফের গলা শোনা যাবে। কিন্তু যায় নি। শমশের আবার বলেছে, ভাবি, আলতাফ ইন্ডিয়াতে গেছে। গেলে তো আর খবর দেওয়ার উপায় নেই, খবর আপনি পাবেনই। আজ হোক কাল হোক, আপনি দেখবেন আলতাফ বেঁচে আছে।
বিলকিস ছেলেটিকে হঠাৎ জিগ্যেস করে, কই, তোমার নাম বললে না তো।
আমার নাম? আমার নাম সিরাজ।
সিরাজ?
ছেলেটিকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখায়। কারণটা ঠাহর করতে পারে না বিলকিস। আশে পাশে কিছু টের পেয়ে গেছে সে, যা বিলকিস বুঝতে পারে নি?
দুপাশে এখনো ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলের ভেতর মিলিটারি ওঁৎ পেতে নেই তো?
বিলকিস ছেলেটির কাছে সরে আসে চলতে চলতে।
সিরাজ, আমরা কতদূর এসেছি?
এখনো অনেক দূর আছে।
অনেক দূর?
কতটুকু আর হেঁটেছেন?
দুমাইল হবে না?
সিরাজ হেসে ফেলে। বলে, কী যে বলেন, দিদি। পরমুহূর্তেই সিরাজ সজাগ হয়ে বিলকিসের মুখের দিকে তাকায়। ভীত গলায় বলে, পা চালিয়ে চলতে হবে। নইলে সন্ধে হয়ে যাবে।
জঙ্গল পেরিয়ে আবার ফাঁকা মাঠের ভেতর পড়ে তারা।
সিরাজ পরামর্শ দেয়, আপনি যদি স্লিপারের ওপর দিয়ে চলতে পারতেন তাহলে তাড়াতাড়ি হতো।
শাড়ি পরে স্লিপার লাফানো যায় না, বাধ্য হয়েই লাইনের পাশ দিয়ে তাকে হাঁটতে হয়।
সিরাজ বলে, একটা গরুর গাড়িও যদি পাওয়া যেত। জলেশ্বরীতে ভোরে ডিনামাইট ফাটার কথা শুনে কেউ আর ওদিকে যেতে চাইল না।
কখন চেষ্টা করলে?
আপনি যখন ইস্টিশান মাস্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
বিলকিস অবাক হয়ে যায়। ছেলেটি সেই তখন থেকে তাহলে তার সুবিধে-অসুবিধের কথা ভাবছে! তার বাবার যারা ছাত্র তারা এখনো নাম শুনলে দাঁড়িয়ে পড়ে। সিরাজ তাঁর ছাত্র নয়, তবু সে তাঁর মেয়ের জন্যে এতটা ভাবছে, ভেবেছে। বিলকিসের গর্ব হয় বাবার জন্যে।