মা ভাই বোনকেও সে আর কোনোদিন কি দেখতে পাবে না?
সুটকেস হাতে নিয়ে বিলকিস উঠে দাঁড়ায়।
ইস্টিশান মাস্টার হাত তুলে যেন বাধা দেবার চেষ্টা করেন। পরমুহূর্তেই আবার হাত ফিরিয়ে নেন তিনি।
তা হলে কী করবেন?
জলেশ্বরীতে যাব।
পাঁচ মাইল হাঁটা।
আমাকে যেতেই হবে। মাস্টার সাহেব একই সঙ্গে উদ্বেগ এবং বিস্ময় বোধ করেন। হেঁটে যেতে পারবেন?
দেখি।
একা আপনি!
একটু থমকে যায় বিলকিস। কী করব?
একটা লোকটোক না হয়, কিন্তু জলেশ্বরীতে এ অবস্থায় কেউ যেতে চায় কি না, সন্ধ্যাও হয়ে আসছে।
এই কমাসে নিজের সাহস এত বড় গেছে, বিলকিস আর অবাক হয় না।
আমি যেতে পারব।
প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে রেললাইনের উত্তর যাত্রার দিকে সে ক্ষণকাল তাকায়। এখনো রোদের উজ্জ্বলতা আছে। ঘন গাছপালার ভেতরে লাইনটা হঠাৎ বাক নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। লাইনের ভেতরে দুপা দিয়ে স্থির হয়ে আছে শাদা একটি গরু। আকাশে এক চিলতে খাড়া ধূসর মেঘ। বারুদের ধোঁয়ার মতো মনে হয়।
বিলকিস রেলের পাশে সরু পায়ে চলার পথ দিয়ে জলেশ্বরীর দিকে এগোয়।
০২. জলেশ্বরী
তার মনে হয় কেউ যেন তার সঙ্গে চলছে। একবার থমকে দাঁড়ায় সে। কান খাড়া করে রাখে। কিছু শোনা যায় না। দুএকটা পাখির ডাক, গাছের পাতায় পাতায় বাতাসের সরসর, ও পাশের বাঁশবনে একবার হঠাৎ ট্যাশ করে একটা শব্দ, আর কিছু না।
বাঁকটা পেরিয়ে যায় সে। পেছনের ইস্টিশান আর চোখে পড়ে না। এবার সমুখে দেখা গুমটি ঘন্ধু। আর অনেক দূর পর্যন্ত ফসলের খোলা মাঠ। রেললাইনটাও দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। হঠাৎ করে সে যেন একটা অনন্তের ভেতর গিয়ে পড়ে। মুহূর্তের জন্যে অবসন্ন বোধ করে। কিন্তু চলার গতি সে থামায় না।
অচিরে তার চোখের সমুখ থেকে সমস্ত কিছু অদৃশ্য হয়ে যায়। দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দাঁড়িয়ে থাকে তার মা, ভাই, বোন, টিনের লম্বা সেই ঘর, ঘরের পেছনে টক আমগাছ। জলেশ্বরীতে অনেক দূর থেকে গাছটা চোখে পড়ে সব সময়। বিলকিস যেন সেই গাছটা লক্ষ করেই এক রোখার মতো এগোতে থাকে।
এবার সে পেছনে শব্দটা শুনতে পায় পরিষ্কার।
ঘুরে তাকিয়ে দ্যাখে, একটা ছেলে, সেই ছেলেটি কাঠের ওপর দিয়ে দৌড়ে আসছে। বিলকিস ঘুরে তাকাতেই ছেলেটি দৌড়ের মুখে আরো কয়েক ক্লিপার এগিয়ে থমকে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। না এগোয়, না ফিরে যায়।
মুহূর্তের জন্যে মনে হয়, ছেলেটির ঐ স্থির দাঁড়িয়ে থাকা নিসর্গের অনিবাৰ্য একটি অংশ। ছেলেটি ধীরে পায়ে আরো কয়েক স্লিপার এগিয়ে আবার থেমে যায়।
তখন মৃদু কৌতূহল অনুভব করে বিলকিস। হাত তুলে সে কাছে আসতে ইশারা করে ছেলেটিকে। নিজেও সে কয়েক পা এগিয়ে যায়।
হাত দশেকের দূরত্বে স্থির হয় দুজন।
এই কী চাও?
তার ছোট ভাইয়ের চেয়েও ছোট হবে বলে বিলকিস তুমি বলতে ইতস্তত করে না। তার একটু রাগও আছে। ছেলেটি সেই ট্রেন থামবার পর থেকেই পিছু লেগেছে।
কী নাম তোমার?
ছেলেটি উত্তর দেয় না, দ্রুত চোখে বিলকিসকে আপাদমস্তক দেখতে থাকে।
তখন থেকে আমার পিছু নিয়েছ কেন?
কেমন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে বিলকিস, ঠিক ভয় নয়, ভয়ের কাছাকাছি। অথচ করবার কিছু নেই। ছেলেটি বরং ভয় পেয়েছে বলে মনে হয় বিলকিসের। কীসের ভয়?
এই এদিকে শোন।
ছেলেটি কাছে আসে। এবং এই প্ৰথম কথা বলে। আপনি ঢাকা থেকে আসছেন?
হাঁ!
জলেশ্বরী যাবেন?
হাঁ, তাই তো যাচ্ছি।
আপনি যাবেন না। ছেলেটির কণ্ঠস্বর হঠাৎ খুব ব্যাকুল শোনায়।
কেন?
আপনি যে একা!
ট্রেন ফিরে গেল। কী করব?
এখন না হয় না-ই গেলেন।
আমাকে যেতেই হবে।
আপনি যাবেন না।
ছেলেটি আবার নিষেধ করে। এবার তার কথার গুরুত্ব বিলকিস উপেক্ষা করতে পারে না। তার ধারণা হয়, ছেলেটি জলেশ্বরী সম্পর্কে ইস্টিশান মাস্টারের চেয়ে কিছু বেশি খবর রাখে।
তুমি মানা করছি কেন? জলেশ্বরীর অবস্থা খুব খারাপ?
খারাপ আর কত হবে। এরই ভেতরে অনেকেই তো যাতায়াত করছে।
আজ ভোরের ঘটনা কিছু জান?
এখনো ভালো করে জানি না। আপনি এভাবে যাবেন না।
সন্ধের আগে পৌঁছতে পারব না?
তাড়াতাড়ি গেলে হয়তো পারবেন।
ছেলেটির ভেতরে কোথায় একটা সারল্য আছে, মিনতি আছে, বিলকিসকে হঠাৎ স্পর্শ করে যায়। সস্নেহে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বিলকিস বলে, তাহলে আমি আর দাঁড়াই না।
সে হাঁটতে থাকে। ছেলেটিও সঙ্গ নেয়।
বিলকিসের ধারণা হয় ছেলেটি সামনে কিছু দূর গিয়েই ফিরে যাবে। কিন্তু ছেলেটিকে নিয়ে তার ভাববার সময় নেই। পুরো পাঁচ মাইল পথ তাকে ভাঙ্গতেই হবে। তার মনে পড়ে না। আর কখনো এতটা পথ সে একটানা হেঁটেছে।
ছেলেটি হঠাৎ বলে, আপনার মতো আমার একটা বোন ছিল।
থমকে দাঁড়ায় বিলকিস। সে আরো একটি দুঃসংবাদ শোনবার জন্যে অপেক্ষা করে। ক্রিয়াপদের অতীত রূপটি একই সঙ্গে তাকে বিষণ্ণ এবং উন্মুখ করে তোলে।
ছেলেটি আর কিছু বলে না। বিলকিস তখন আবার হাঁটতে শুরু করে। ছেলেটি নীরবে তার পাশে পাশে চলে।
দুধারে জনশূন্য মাঠ। এরকমও মনে হতে পারত মানুষের বসতি এখানে নেই। কিন্তু আছে। মানুষ এমন একটা সময়ে নিজেকে গোপন রাখতেই ক্রিয়াশীল। তাই জামগাছের তলা নির্জন, হঠাৎ যে একটা বসবার বাঁশের মাচা খাঁ খ্যা করছে। এমনকি গৃহস্থের পালিত পশুও চোখে পড়ে না। ডোবার সবুজ পানিতে ঝুঁকে পড়া বেত গাছের তীক্ষ্ণ পাতা থর থর করে। একটি কাক স্তব্ধতাকে কাঁপয়ে দিয়ে উড়ে যায়।