ওকে এখন তোমরা কী করবে? প্ৰদীপের দিকে চোখ রেখেই বিলকিস উচ্চারণ করে।
মেজর সে প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
বন্দুক কেড়ে নিতে গেল কেন? প্ৰাণটা হারাল।
নীরবতা।
মেজর বলে চলে, প্ৰাণ অবশ্য হারাত। স্বীকারোক্তি পাবার পর ইন্ডিয়ায় পাঠানো হতো। রসিকতাটি মনে করে মেজর মৃদু হেসে ওঠে।
তোমারা কি ওকে ফেলে রাখবো?
মেজর নিঃশব্দে মৃদু মৃদু হাসে।
যেমন বাজারে ফেলে রেখেছ?
মেজর ফ্ল্যাক্স থেকে শেষ ফোঁটাটুকু পর্যন্ত গলায় ঢেলে পা সমুখে লম্বা করে দেয়।
আমার দিকে ফিরে তাকাও।
বিলকিস নত হয়ে প্রদীপের চোখ দুটো বুজিয়ে দেয়।
জান? আমি কখনো হিন্দু মেয়েকে ন্যাংটো দেখি নি।
অন্তত সে বিশ্বাস করেছে। এরা ভাইবোন। তাই বিলকিসকেও হিন্দু ধরে নিয়েছে।
চোখ বুজিয়ে দিয়ে হাত সরিয়ে নেয় না বিলকিস। প্ৰদীপের গালের ওপর তার দুটি হাত স্থির হয়ে থাকে।
আমাকে একটা কথা বল, হিন্দু কি প্রতিদিন গোসল করে?
নীরবতা।
হিন্দু মেয়েদের গায়ে নাকি কটু গন্ধ?
নীরবতা।
তাদের জায়গাটা পরিষ্কার?
নীরবতা।
শুনেছি, মাদী কুকুরের মতো। সত্যি?
নীরবতা।
শুনেছি, হয়ে যাবার পর সহজে বের করে নেওয়া যায় না?
নীরবতা।
আমাকে কতক্ষণ ওভাবে ধরে রাখতে পারবে?
বিলকিস প্রদীপের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেজরের দিকে তাকায়–আমি এর সৎকার করতে চাই।
তোমাকে এখন বাধ্য করতে ইচ্ছে করছে।
আমার ভাইয়ের সৎকার আমি করব।
বিলকিস উঠে এসে মেজরের সমুখে দাঁড়ায়। দ্রুত নিজের পা টেনে নেয় মেজর। কাপড় খুলে ফ্যালে।
চোয়াল চিবিয়ে মেজর উচ্চারণ করে। তার চোখ বিস্ফারিত হতে থাকে। কপালের পাশে শিরা দীপ দপ করে।
বিলকিস স্থির কণ্ঠে বলে, আগে আমার ভাইয়ের সৎকার করব।
ধীরে চোয়াল শিথিল হয়ে আসে মেজরের, মিলিয়ে যায় কপালের শিরা, চোখ স্মিত হয়। উঠে দাঁড়িয়ে মেজর বিলকিসের কাঁধে হাত রাখে। সঙ্গে সঙ্গে সরে যায় বিলকিস।
ঠিক আছে। সৎকার হবে। আমি বলি নি, অত্যন্ত সহিষ্ণু আমি?
১৫. সৎকার
মাটি খুঁড়তে কতক্ষণ আর লাগে? ইস্কুলের পাশেই?
না।
তাহলে আবার কোথায়?
কবর নয়।
হঠাৎ খেয়াল হয়। শিস দিয়ে ওঠে মেজর।
ভুলেই গিয়েছিলাম, হিন্দু। হিন্দুরা কবর দেয় না। পোড়ায়। পোড়ায় কেন?
নীরবতা।
খোদা মানুষকে মাটি থেকে তৈরি করেছেন। আর শয়তানকে আগুন থেকে। সেইজন্যই হিন্দুরা আগুনে ফিরে যায়।
নীরবতা।
আগুন।
মেজর মৃদু স্বরে শব্দটা উচ্চারণ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নেয়।
দুটিন পেট্রল হলেই চলবে তো?
না।
একটা মানুষ পোড়াতে দুটিনের বেশি লাগে না। যথেষ্ট।
কাঠ চাই।
কাঠ?
সম্ভব হলে চন্দন কাঠ চাইতাম।
মেজর আবার শিস দেয়।
স্যান্ডল উড?
কাঁধ ঝাঁকুনি দেয় সে। অদ্ভুত মনে হয়। কৌতুক অনুভব করে।
আর বিলকিস ফিরে পায় তার সেই অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতা, গত রাতের মতো স্থির প্রেরণা।
কাঠ চাই।
এত রাতে কাঠ কোথায় পাবে?
আমি জানি না।
আমার সহিষ্ণুতার পরীক্ষা করছ না তো?
নীরবতা।
মৃত্যু তোৰ হোক। বিপ্লবীদের খবর দেব দিয়ে আসতে। আমি অপেক্ষা করতে তৈরি। তুমি?
অপেক্ষা কাঠের জন্যে নয়, বিলকিসের জন্যে অপেক্ষা করতে সে প্রস্তুত, এটা স্পষ্ট হয় মেজরের নিঃশব্দ হাসিতে বিদীর্ণ মুখ দেখে।
সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে বিলকিস যে উত্তর দেয় মেজরের তা বোধগম্য হয় না, তাই বিচলিত বোধ করে না।
আমিও তৈরি।
প্রদীপের গালে একটু আগে, দুহাত স্থাপন করবার মুহূর্তেই নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছিল। বিলকিস। তাই তার কণ্ঠস্বর এখন উদাস, বর্তমান থেকে বিযুক্ত এবং উচ্চারণ সংক্ষিপ্ত।
কাঠ এখানে নয়।
তাহলে কোথায়?
নদীর তীরে।
নদীর তীরে কেন?
মেজর হঠাৎ তীক্ষ্ণ চোখে বিলকিসকে বিদ্ধ করে। মুহূর্তের জন্যে সুরা ও নারীর নেশা
অন্তর্হিত হয়ে যায়। হিন্দু মেয়েটার কোনো মতলব নেই তো? নদীর ওপারে ইন্ডিয়া খুব বেশি দূরে নয়। মাত্র তিরিশ মাইল, পাখির উড্ডয়নে।
হিন্দুদের সৎকার নদীর তীরে হয়।
অদ্ভুত!
আবার কাঁধ বাকুনি দেয় মেজর।
আচ্ছা, বিহারীদের জিগ্যেস করব। যদি তারা বলে হিন্দুদের দাহ নদীর তীরে হয় তো নদীর তীরেই হবে। আরেকটা কথা বল—। তোমাদের কোন দেবীর নাকি পাঁচ স্বামী ছিল?
ছিল!
মেজর লম্বা করে শিস দেয়।
ভোর হয়ে যায়।
প্ৰদীপের লাশের পাশে খোদিত মূর্তির মতো বসে থাকে বিলকিস। অনেকক্ষণ। তারপর শাড়ি দিয়ে প্রদীপের দেহ থেকে রক্ত মুছে ফেলতে চেষ্টা করে সে। কিছু ওঠে, কিছু ওঠে না। মানচিত্রে দ্বীপের মতো রক্তের চিহ্ন প্ৰদীপের শরীরে অংকিত হয়ে থাকে।
দুপুরের দিকে মেজর ফিরে আসে।
চল।
জনা চারেক বিহারী ছোঁকরাকে দেখা যায়। সম্ভবত এরাই বাজারে দেখা দিয়েছিল। এখন তারা প্ৰদীপের লাশ নিয়ে বাইরে পিকআপ ভ্যানে তোলে। বিলকিসকে উঠতে ইশারা করে মেজর। তারপর দুজন সৈনিকের সঙ্গে সে সমুখে গিয়ে বসে। আরো দুজন সৈনিক লাফিয়ে ওঠে পেছনে।
ইস্কুলের মাঠ ছেড়ে জলেশ্বরীর জনশূল্য সড়ক দিয়ে চোখ ঝলসানো রোদ্দুরের ভেতরে ভ্যান আধকোশা নদীর দিকে ছুটে যায়। মোটরের গর্জন স্তব্ধতাকে আরো বিকট করে তোলে।
আধিকোশার নিকটতম তীরে এসে দেখা যায় সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে আরো কয়েকজন বিহারী ছোকরা। তারা একস্তুপ কাঠের অদূরে বন্দুক হাতে নিয়ে লম্বা পায়ে টহল দিচ্ছে। নদীর তীরও একই প্রকার জনশূন্য। জল বয় না। পাখি ওড়ে না। নদী শুকিয়ে পাড়ে যে বিস্তৃত বালির বিছানা হয়ে আছে, রোদুরে উত্তপ্ত হয়ে আছে, খালি পায়েও বিলকিস তা অনুভব করতে পারে না।