দেয়ালের গায়ে অকস্মাৎ গেলাস ছুঁড়ে দিয়ে মেজর চিৎকার করে বলে, আমি বলেছি, বাধ্য তোমাকে করব না। আমি এখন কুকুরের সঙ্গে কুকুরের মিলন দেখব।
শরীরের ভেতরে মেজর প্রবল আকর্ষণ বোধ করে নিজের হাতে বিলকিসকে বিবসনা করবার জন্যে। এক পা কাছেও আসে। কিন্তু অন্তঃস্থল থেকে দুর্বল বোধ করে সে। গুলি করতে ইচ্ছে হয়, করে না, তার বদলে আর্দলীকে ডাকে। নির্দেশটা তাকেই দেয়।
আর্দালি সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে রূঢ় গলায় বিলকিসকে উঠে দাঁড়াতে বলে। বিলকিস যেন শুনতে পায় নি। তখন তার বাহু ধরে হ্যাচক টান দেয় আর্দালি।
মেজর ঈষৎ বিরক্ত গলায় বলে, আহ, ধৈর্যের সঙ্গে কাজ কর।
আর্দালির বলবান দেহটিকে সে ঈর্ষা করে আর সেটা চাপা দেবার জন্যে আরো খানিকটা পান করে।
হাজার হাজার বছর কাপড় পরে মানুষের রক্তের ভেতর আচ্ছাদনের প্রয়োজনীয়তা ঢুকে গেছে। পোশাক তার দ্বিতীয় ত্বক। সেই ত্বকে টান পড়তেই বিলকিসের প্রতিক্রিয়া হয় বাধা দেবার। সে দেয়, কিন্তু সফল হয় না। আর্দালি অবিলম্বে তার শাড়ি হরণ করে নেয়।
আহ, ধৈৰ্য, ধৈৰ্য।
চেয়ারে বসে মেজর ক্রমাগত মাথা এপাশি-ওপাশ করতে থাকে।
আর্দালির হাতে বিলকিসের দেহ-স্পর্শ কল্পনা করে সে নিজের হাতের তালু অনবরত কচলাতে থাকে।
জুম্মা খাঁ, ধৈর্য।
বিবসনা হয়ে যায় বিলকিস। দৃষ্টিপাত করেই চোখ ফিরিয়ে নেয় মেজর। চোখের পাতা অন্তিম পর্যন্ত বুজে, হাত কচলে নগ্ন রমণীর স্মৃতি যেন সে পিষ্ট করে ফেলতে চায়। মুখ সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ফিরিয়ে রেখেই আর্দালিকে সে কাছে ডেকে অস্ফুট স্বরে আদেশ করে সিরাজকে নিয়ে আসতে।
আর্দালি বেরিয়ে যেতেই মেজর ধীরে ধীরে মুখ ফেরায়, চোখ ফেরায়, প্রথমে মিটমিট করে, তারপর পরিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে দ্যাখে। উঠে দাঁড়িয়ে বেশ দূরত্ব সত্ত্বেও কণ্ঠ না তুলে, ফিস ফিস করে বলে, সুন্দর দেহ!
খাটো বন্দুকধারী এক সৈনিক সিরাজকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসে।
সিরাজ তার প্রহরাধীন বলে সৈনিক চলে যায় না। নগ্ন রমণী দেখে তার মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। সে দরোজার কাছে সটান দাঁড়িয়ে থাকে দরোজার পাল্লার দিকে তাকিয়ে।
ঘরে ঢুকেই বিলকিসকে দেখে চোখ বুজে ফেলে সিরাজ। অবসন্ন দেহে চোখ বুজেই সে দাঁড়িয়ে থাকে। বিলকিস চোখে বোজে না। তার চোখ উন্মুক্ত এবং স্থির।
সিরাজের চারপাশে একবার ঘুরে আসে মেজর। তারপর আর্দালিকে নির্দেশ দেয় এবার উচ্চ কষ্ঠে, একেও ন্যাংটো কর।
চমকে উঠে সিরাজ চোখ খোলে। চোখ খুলতেই বিলকিসকে দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে সে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের কোমরের নিচে চেপে ধরে।
আর্দালি তার শার্ট খোলার চেষ্টা করেও যখন পরাস্ত হয়, টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে শার্ট। সঙ্গে সঙ্গে নতজানু হয়ে সিরাজ মুষ্ঠিবদ্ধ হাত কোলের ওপর চেপে ধরে মাথা নিচু করে গুটিয়ে রাখে নিজেকে। তার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।
তখন মেজর লাথি মেরে কাৎ করে দেয় তাকে। আর্দালি ঝাঁপিয়ে তার বুকের ওপর উল্টোমুখে বসে ট্রাউজারের বোতাম বদ্ধমুষ্ঠির ভেতর থেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে।
সিরাজ চিৎকার করে ওঠে, না।
নিঃশ্বাসরুদ্ধ করে বিলকিস দাঁড়িয়ে থাকে। শরীর চৈতন্য থেকে স্বাধীন হয়ে যায় এবং তার শরীরও থরথর করে কাঁপতে থাকে।
নাআআ।
মেজর পা দিয়ে সিরাজের বুকের ওপর চেপে ধরে বলে, বাঙালিরা কুকুরের অধিক নয় কুকুরের ভাইবোন নেই।
সিরাজের হাত দুটো ছাড়িয়ে আর্দালি নিজের ভাঁজ করা দুই হাঁটুর তলায় চেপে ধরে রাখে। তারপর বোতামে হাত দেয়।
না না না।
পটপট করে বোতামগুলো খুলে ফেলে আর্দালি।
বিলকিস চোখ বন্ধ করে। একটু আগে সে থরথর করে কাপছিল, এখন স্থির হয়ে যায়।
আর্দালি প্রথম অনুধাবন করতে পারে না। মুহূর্তের জন্যে সে বিমূঢ় হয়ে যায়। তারপর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজনায় চিৎকার করে বলে, স্যার, ইয়ে তো হিন্দু হ্যায়?
১৪. শাড়ি
শাড়িটা পায়ের কাছ থেকে কুড়িয়ে নেয় বিলকিস। শাড়ি পরিবার নানা রকম কৌশল জানার সুখ্যাতি যার, সে এখন লজ্জা নিবারণ করে মাত্র।
কয়েকজন সৈনিক ও একজন ক্যাপ্টেন ছুটে এসেছিল, মেজর নিঃশব্দে তাদের চলে যেতে ইঙ্গিত করে।
ক্যাপ্টেন জানতে চায়, কোনো সাহায্য করতে পারি, স্যার?
মেজর মাথা নাড়ে।
ক্যাপ্টেন ও সৈনিকেরা চলে যায়। কেবল দরোজার প্রহরী দাঁড়িয়ে থাকে। তারই প্রহরাধীন ছিল। মেজর নিঃশব্দে তাকে ইশারা করে সরিয়ে নিয়ে যেতে। সৈনিকটি উবু হয়ে হাত ধরে টেনে নেবার উদ্যোগ করতেই এই প্রথম বিলকিস কথা বলে ওঠে। সংক্ষিপ্ত প্ৰবল একটি শব্দ।
না।
তার কণ্ঠস্বরে আকস্মিকতায় বিস্ময় বোধ করে মেজর।
না।
মেজর একটু চিন্তা করে প্রহরী সৈনিকটিকে চলে যেতে ইশারা করে। অনেকক্ষণ নিষ্ক্রিয়তার পর মেজর ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে বলে, মৃতদেহ আমি পছন্দ করি না। পরাজয়ের কথা আমাকে মনে করিয়ে দেয়।
বিলকিস অতি ধীর পায়ে প্রদীপের লাশের পাশে এসে দাঁড়ায়।
একই ধীর গতিতে সে হাঁটু গেড়ে বসে। অনেকক্ষণ ধরে প্রদীপের টক-টকে লাল রক্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। পেট্রোম্যাকসের আলোয় অবিশ্বাস্য উজ্জ্বল দেখায়, এমনকি কৃত্রিম মনে হয় এই রক্ত। গেলাসটা খুঁজে না পেয়ে মেজরের স্মরণ হয় নিজেই সে ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেলেছিল। তখন সরাসরি ফ্ল্যাক্স থেকেই গলায় খানিকটা ঢালে সে। গেলাস অথবা প্রদীপের জন্য খানিকটা খেদ তার কণ্ঠস্বরে লক্ষ করা যায়।