বিলকিসও নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকে।
বিলকিস ও সিরাজ দুটি আলাদা ঘরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
একাকী ঘরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন চলতে থাকে। তোমার নাম?
সিরাজ।
বাড়ি?
জলেশ্বরী।
তোমার বোনের নাম?
বিলকিস।
ধর্ম?
ঠিক আগেই বিলকিসের উল্লেখ ছিল, তাই মিথ্যা না বলেও নিরাপদ উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। মুসলমান।
ইন্ডিয়া কবে গিয়েছিলে?
ইন্ডিয়া যাই নি।
ইন্ডিয়া থেকে কবে এসেছ।
আমি এখানেই ছিলাম।
ইন্ডিয়া থেকে কজন এসেছে?
জানি না।
ইন্ডিয়া থেকে কারা এসেছে?
জানি না।
তাদের নাম কী?
জানি না।
কোথায় আছে?
জানি না।
খালের পুলে ডিনামাইট কে পেতেছে?
জানি না।
সড়কে মাইন কে পেতেছে?
জানি না।
কী জান?
নীরবতা।
কলমা জান?
নীরবতা।
নামাজ জান।
নীরবতা।
গালে প্ৰচণ্ড একটা চড় বসিয়ে মেজর চিৎকার করে ওঠে, বোনের সঙ্গে শুতে জান?
স্তম্ভিত হয়ে যায় সিরাজ।
তার গালে চড় মেরে এক ধরনের উপশম হয় মেজরের। বিলকিসের শরীর এবং সম্ভাবনা তাকে অনবরত তাড়না করে চলেছিল। সৈনিককে সে নির্দেশ দেয় প্রহার চালিয়ে যাওয়ার জন্যে। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে বিলকিসকে যে ঘরে রাখা হয়েছে, সেখানে ঢোকে।
সেখান থেকে সিরাজের তীব্র আর্তনাদ শোনা যায়। মেজর ঘরে ঢুকতেই বিলকিস তার দিকে দৃষ্টিপাত করে। না, তোমাকে প্রহার করব না। স্বীকারোক্তির জন্যে তোমাকে বাধ্য করব না। মেজর কাছে এগিয়ে আসে।
স্বীকারোক্তি তোমার ভাই করবে।
নীরবতা।
কোনো কিছুর জন্যেই তোমাকে বাধ্য করব না, এমনকি তোমার দেহের জন্যেও নয়।
বিলকিস মেজরের দিকে ঘুরে তাকায়।
মেজর নিঃশব্দে হাসে।
তুমি নিজেই আমার কাছে আসবে।
দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেয় বিলকিস।
দূরে সিরাজের আর্তনাদ এখন গোঙানিতে পরিণত হয়। তারপর হঠাৎ তা স্বন্ধ হয়ে যায়। দিনের সূর্য অস্ত যায়। রাতের চাঁদ উঠে আসে। ইস্কুলের মাঠে ফুটবলের গোলপোস্টকে আতিবিস্তৃত ফাঁসি কাষ্ঠের মতো দেখায়। টিনের ছাদের নিচে চামচিকে ঝুলে থাকে। দূরে কোথায় তক্ষক ডেকে ওঠে। বহুক্ষণ অনুপস্থিতির পর মেজর আবার আসে।
হাঁ, তুমি নিজেই আমার কাছে আসবে।
নীরবতা।
আমি বাধ্য করব না। কাউকে আমি বাধা করি না।
মেজর মনে করতে চায় না। কিন্তু মনে না করে পারে না তার নিজের একটি শারীরিক অক্ষমতার কথা। বড় দ্রুত ব্যয়িত হয়ে যায় সে। সেই অভাবটুকু তাকে পূরণ করতে হয় আত্মম্ভিরতা দিয়ে। রমণীর প্রতি একই সঙ্গে প্ৰবল আকর্ষণ ও গভীর বিরক্তি সে বোধ করে থাকে।
আসলে আমি অত্যন্ত সহৃদয়।
নীরবতা।
সহৃদয়তার পরিচয় তুমি পেয়েছ আমার সহিষ্ণুতায়। নিশ্চয়ই শুনেছি, আমার বন্ধুদের অনেকে রমণীদের বাধ্য করেছে। আমি করি নি।
নীরবতা।
তুমি স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে মিলিত হবে।
নীরবতা।
পানি দেওয়া হয়েছে, গোসল কর নি কেন?
নীরবতা।
খাবার দেওয়া হয়েছে, খাও নি কেন?
নীরবতা।
লেখাপড়া কতদূর করেছ? দেখে শিক্ষিত মনে হয়।
নীরবতা।
ইংরেজি বলতে পোর?
নীরবতা।
যে মেয়ে ইংরেজি বলতে পারে, আমি তাকে পছন্দ করি।
নীরবতা।
তারা বোঝে। মনের প্রয়োজন বোঝে। শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজন বোঝে।
নীরবতা।
তুমি বিবাহিতা? অবশ্যই তুমি বিবাহিতা। তোমাকে দেখায় বিবাহিতা। তোমার স্বামী, কী বলে, তোমার সঙ্গে, কী বলে, একইভাবে প্রতি রাতে মিলিত হয়?
নীরবতা।
তোমার স্বামী কোথায়? ইন্ডিয়ায়? জান, হঠাৎ হাসি পেল কেন? আমাদের হাতে কেউ মৃত্যুদণ্ড পেলে আর তার আত্মীয়স্বজন খোঁজ নিতে এলে আমরা বলি–ইন্ডিয়ায় চলে গেছে।
নীরবতা।
একইভাবে না বিভিন্নভাবে?
নীরবতা।
মেজর ফ্লাক্স খুলে হুইস্কি ঢেলে নেয়। নিঃশব্দে পান করে অনেকক্ষণ ধরে। বিলকিসের থেকে চোখ এক মুহূর্তের জন্যে ফিরিয়ে নেয় না। বাইরে টহলদার সৈনিকদের পদচারণা শোনা যায়।
আচ্ছা, অন্তত একটা কথার উত্তর দাও। আমি তোমাকে আকৃষ্ট করি?
নীরবতা।
আমি অপেক্ষা করতে পারি। আজ রাতে আমার ডিউটি নেই। উত্তর পেলে কালও আমি ছুটি নিতে পারি। উর্দু না জানলে ইংরেজিতে উত্তর দাও। যারা ইংরেজি বলে আমি পছন্দ করি। তুমি আমাকে পছন্দ কর?
চেয়ার টেনে কাছে সরে আসে মেজর।
ভরসা দিতে পারি, তুমি আমাকে পছন্দ করবে।
মেজর আরো খানিকটা সুরা ঢেলে নেয়।
কেন করবে না? আমার বীজ ভালো। আমার রক্ত শুদ্ধ। রমণী স্বয়ং উদ্যোগী হলে অবশ্যই আমাতে তৃপ্ত হতে পারবে। আমি কি তোমাকে আকৃষ্ট করি? আমি তোমোয় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমান রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানি হবে, চাও না সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানি রেখে যাব, ইসলামের নিশান উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে। আমি শুনেছি, বাঙালিদের গানের গলা আছে। আমি কি তোমাকে আকৃষ্ট করি?
ঢক ঢক করে অনেকটা সুরা এবার গলায় ঢেলে নেয়। মেজর। এতক্ষণের বিরতি পুষিয়ে নেয় একবারে। স্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে বিলকিসের দিকে। সেখান থেকে সাড়া আসে না। বিলকিস স্থির দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে নিবদ্ধ থাকে।