তিনজন নীরবে তার দিকে তাকায়।
ইস্টিশান মাস্টার উত্তর দেন, না।
কেন?
নীরবতা।
যাবে না কেন?
তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইস্টিশান মাস্টার গার্ডকে বলেন, আর দেরি করবেন না। অর্ডার আছে ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাক করে দিতে। পথে সন্ধে হয়ে গেলে, বলা যায় না, কী হয়।
গার্ড চকিতে মাস্টারের দিকে তাকান। দুজনের ভেতর অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হয়। আর সে দাঁড়ায় না। নিশান দুটো তুলে নিয়ে সোজা ট্রেনের দিকে ধাবিত হয় সে। ইনজিন ড্রাইভার হয়তো আরো কিছু বিরক্তি প্ৰকাশ করতে চায়। সে সঙ্গে সঙ্গে নড়ে না। ইতস্তত করতে থাকে।
যান, যান, আপনি আর ঝামেলা বাড়াবেন না।
ড্রাইভার বেরিয়ে যায়।
ইস্টিশান মাস্টারও উঠে দাঁড়ান। তিনি ড্রাইভারের পেছনে পেছনে দরোজা পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকেই গলা বাড়িয়ে ট্রেনটিকে দেখতে থাকেন।
বিলকিস বসবে কি দাঁড়িয়ে থাকবে বুঝতে পারে না। ক্ষণকালের জন্যে তার এমনও মনে হয় এই ট্রেনে ফিরে যায়। কিন্তু সে ভালো করেই জানে, ফিরে যাওয়া নয়, জলেশ্বরীতেই তাকে যেতে হবে।
হঠাৎ সে দেখতে পায় ইস্টিশান ঘরের পেছনের জানালায় একটি মুখ। সেই ছেলেটির মুখ। আবার চোখ পড়তেই মুখটি সরে যায়।
ইনজিনের দীর্ঘ হিস শোনা যায়। বঁশি বাজে না। চাকা নড়ে ওঠে। ঘরের ভেতর থেকে বগিগুলো সরে যেতে দেখা যায়। সবশেষে ইনজিন। পেছন থেকে ঠেলে নিয়ে তোরসায় ফিরে যাচ্ছে। সে যে ঘরের ভেতর আছে ইস্টিশান মাস্টার হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন। ট্রেন বেরিয়ে যাবার পর তিনি ঘরের ভেতরে মুখ ফিরিয়ে মুহূর্তের জন্য নিশ্চল হয়ে যান। ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না, কে বসে আছে। তাকে দোষ দেওয়া যায় না। ঘরটি এত নিচু, ঘরের জানোলা এত ছোট যে যথেষ্ট আলো আসে না। দুপুরবেলাতেও সন্ধ্যাভাষ ফুটে থাকে।
আপনি ঢাকা থেকে আসছেন?
হাঁ।
জলেশ্বরী যাবেন?
আমার যাওয়া দরকার। ইস্টিশান মাস্টার চিন্তিত মুখে চেয়ারে বসে পড়েন। হাত উল্টে বলেন, আমার কিছু করবার নেই। তারপর হয়তো তার মনে হয়, একজন বিপন্ন মহিলাকে এভাবে সরাসরি নিরাশ করাটা উচিত হলো না। কিন্তু আশা দেবারও আলো তার হাতে নেই। পুষিয়ে দেবার জন্যে তিনি সহানুভূতিশীল গলায় জানতে চান, জলেশ্বরীতে আপনার কেউ আছে?
আছে। মা আছে। ছোট ভাই আছে, রংপুর কলেজে পড়ে। আমার বড় বোন বিধবা, সে আছে, তার দুটো ছেলেমেয়ে আছে।
জলেশ্বরীতে কী হয়েছে? নিজের খবর দ্রুত গলায় দিয়ে যে প্রশ্নটি এতক্ষণ মনের ভেতরে কঠিন মুষ্ঠির মতো চেপে বসেছিল, বিলকিস। উচ্চারণ করে।
সরাসরি সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাস্টার সাহেব বলেন, কিন্তু আপনি এখন যাবেন কী করে? পাঁচ মাইলের পথ!
চোখের সমুখে হঠাৎ যেন আগুন জ্বলে ওঠে দাউ দাউ করে। বিলকিস দেখতে পায় জলেশ্বরী পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আবার দেখতে পায় সে আগুন নিভে গেছে। জলেশ্বরীর বাড়িগুলো বীভৎস ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারা শহরে একটিও প্রাণী নেই। বিকট জন্তুর মতো স্তব্ধতা হামা দিয়ে শহরটিকে খাবলে খাবলে খেয়ে চলেছে। ধড় ফড় করে উঠে দাঁড়ায় বিলকিস। তার ঠোঁট থেকে ভয়ার্ত প্রশ্ন গড়িয়ে পড়ে।
জলেশ্বরীতে কি যাওয়া যাবে?
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে মাস্টার সাহেব উত্তর দেন–ঠিক বলতে পারছি না।
আপনি কী শুনেছেন?
খুব ভালো না।
কী ভালো না?
ভাই বোন, মায়ের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা তার কণ্ঠ ফুটে বেরোয়। একবার মনে হয়, আর কখনো তাদের মুখ দেখতে পাবে না। যেমন, সে তার স্বামী আলতাফের মুখ আর কখনো দেখতে পাবে আশা করে না।
মাস্টার সাহেব বলেন, ভালোই তো ছিল সব। এতদিন কোনো গোলমালই ছিল না।
আমিও তো চিঠি পেয়েছি মায়ের গত বুধবার।
বললাম তো, এদিকে কোনো গোলমালই ছিল না।
ইস্টিশান মাস্টার আড় চোখে একবার বিলকিসকে ভালো করে দেখে নেন। অচেনা একজনকে এত কথা বলা ঠিক হবে কি না, মীমাংসা করতে পারেন না। কোনো পুরুষ হলে হয়তো তিনি রূঢ়ভাবে বিদায় দিতেন, মহিলা বলে ইতস্তত করেন।
আবার সুশ্ৰী শহুরে একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলবার সুযোগটা এই আতংকশাসিত সময়ের ফাটলে অবিরাম পতনোনুখ অবস্থার ভেতরও একেবারে সংক্ষেপে ছেড়ে দেবার ইচ্ছা তিনি বোধ করেন না।
এদিকে এই চার মোস সব চুপচাপ ছিল। মার্চ মাসে ঢাকার ঘটনার পর, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রংপুর থেকে মিলিটারি আসে।
তখন সবাই জলেশ্বরী থেকে চলে যায়, আমার ভাই লিখেছিল।
এখান থেকেও অনেকেই সরে গিয়েছিল। শুধু জলেশ্বরী কেন? আধিকোশা নদী পার হয়ে সব ঐ পারের গ্রামে যায়। মিলিটারি ফিরে যাওয়ার পর, বিহারীদের লুটের ভয়ে, তারপর মিলিটারি বলে যায়–যারা ঘরে ফিরবে না। তাদের ঘর জ্বলিয়ে দেওয়া হবে, সেই ভয়ে আস্তে আস্তে লোকেরা ঘরে ফিরে আসে। তারপর এই কয় মাস একেবারে কিছু না। মাঝে মাঝে শোনা যায়, ইন্ডিয়া যারা গেছে, তারা যুদ্ধ করতে আসছে। কিন্তু সে রকম কিছু দেখা যায় না। হঠাৎ আজ খুব ভােরবেলায়, আমি যা শুনলাম, জলেশ্বরী ডাকবাংলা, তার ঠিক আগে যে খাল আছে, আধিকোশায় গিয়ে পড়েছে, সেই খালের ওপর রেল-পুল, সেখানে ডিনামাইট ফাটে। তারপর আর কিছু শুনি নি।
অনেকে বলে মিলিটারি জলেশ্বরীতে গুলি করেছে।
মিলিটারি ছিল ওখানে?
গত মাসে তারা একটা ক্যাম্প করে। এর আগে ছিল না।
লোকজন?
কেউ কিছু বলতে পারে না।
বুকের ভেতরে শীতল বরফ অনুভব করে বিলকিস। আলতাফের কথা একবার মনে পড়ে যায়। এই কমাসের অনুপস্থিতিতে আলতাফের চেহারার চেয়ে তার অস্তিত্বটাই প্রথম উজ্জলতরভাবে মনে পড়ে।