চিবুকের নিচে বিলকিসের হাতটা হঠাৎ দুহাতে চেপে ধরে সিরাজ।
বড় অকস্মাৎ বড় অপ্রত্যাশিত মনে হয় তার এই প্ৰাণপণে আঁকড়ে ধরা।
মুহূর্তকাল পরে একই আকস্মিকতার সঙ্গে হাতটা ছেড়ে দিয়ে সিরাজ বলে, দিদি। আমি আপনাকে একটা মিথ্যে কথা বলছি।
তার এই ঘোষণাটি আরো প্ৰত্যাশিত।
আমি সিরাজ নই। মনসুরদা আমাকে এই নাম দিয়েছেন। আমি প্ৰদীপ।
প্ৰদীপ?
শ্ৰী প্ৰদীপ কুমার বিশ্বাস।
তবু তুমি এখানে আছ?
আছি। ইন্ডিয়া যাই নি। এখানে থেকে এখানেই আবার আমি প্ৰদীপ হতে চাই। দিদি, আপনি বুঝতে পারেন আমার দুঃখ? মা-বাবা-বোন, আমার নাম, আমার পরিচয় একটা মাত্র রাতে আমার সব কিছু হারিয়ে যাবার দুঃখ? দিদি, আমাদের ধর্মে বলে, ধৰ্মই মানুষকে রক্ষা করে। কই, আমার ধর্ম তো আমাকে রক্ষা করতে পারল না?
কথাগুলো বিলকিস ভালো করে শুনতে পায় না। তার মনের ভেতরে বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত ছেলেটির টুকরো টুকরো কথা, আচরণ, প্রতিক্রিয়া, সম্বোধন দ্রুত আবতির্ত হতে থাকে।
প্ৰদীপ।
দিদি।
কে বলে তুমি ভীতু? তোমার জন্যে আমার গর্ব হয়।
১০. পাটের গুদাম
রাত কেটে যায়। বাইরে ভোর হয়ে গেলেও ভেতরে অন্ধকার কাটে না। তারপর সূর্য যখন প্রবল হয় তখন ভেতরটা একটু ফিকে হয়ে আসে। সেই অস্বাভাবিক গোধূলিতে দেখা যায় স্তুপাকার পাটের ভেতরে সরু পথের দুই প্রান্তে আছে দুজন। মৃত্যুর যে কনিষ্ঠ ঘুম, মৃত্যুর মতোই আমোঘ ও অনিবার্য। এই দুটি মানুষের গতকালের শ্রম, শোক, আকস্মিকতা এখন নিপুণ হাতে নিরাময় করে চলছে ঘুম। বাইরে, পাটের স্তুপের পেছনে টিনের একটা দেয়ালের ওপারেই লাশের সংখ্যা কম দেখে বিহারীদের বিস্ময়, কোলাহল, দৌড়, সৈন্যদের খবর পেয়ে আসা, শেয়ালে খুড়ে ফেলা খালপাড়ের ঐ কবর আবিষ্কার, আকাশে সৈন্যদের গুলি ছোড়া, কিছুই ঘুমের চিকিৎসাধীন মানুষ দুটির শ্রবণে পশে না। বিহারীরা বাঙালিদের একটা পাড়া দৃষ্টান্ত হিসাবে পুড়িয়ে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে স্থায়ীন ছাউনির অধিনায়ক মেজর সংক্ষিপ্ত না বলে তাদের নিরস্ত করে। মেজর তাদের জানায় না যে, গত রাতে রংপুর জলেশ্বরী একমাত্র সড়কটির ওপর পাতা মাইনে সেনাবাহিনীর একটা জিপ উড়ে যায়, তিনজন নিহত হয়। বিহারীরা জলেশ্বরীতে কোনো বাঙালির সন্ধান না পেয়ে আলেফ মোক্তারের বাড়িতে ঢোকে এবং গলায় ফাঁস টেনে তাকে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। তাদের অগোচরে জলেশ্বরী বাজারেই দুটি বাঙালি অকাতরে ঘুমায়। যেখানে তারা ঘুমিয়ে সেই গুদামের ঠিক বাইরে দিনের রৌদ্রোজ্জ্বল নিরাপত্তার ভেতরে বিহারী কয়েকটি যুবক বন্দুক ঘাড়ে করে টহল দেয়। তাদের কিছু আত্মীয়, কিছু বন্ধু, বিক্ষিপ্ত লাশগুলো থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসে থাকে, সিগারেট ফোকে। কারো কারো গলায় জরির সরু মালা। সৈন্যরা জলেশ্বরীতে প্ৰথম আসবার পর থেকে এই শখটি বিহারীদের কারো কারো ভেতরে দেখা যায়।
১১. বন্দুক
অন্ন কিংবা জল কিছুই নয়, এখন তারা অপেক্ষা করে থাকে মধ্যরাতের জন্য। বিলকিস বলেছিল, পাটের গুদামের ভেতরে কথা বললে বাইরে থেকে শোনা যায় না, তবু জেগে ৪ঠার পর, নিজেদের এই মসৃণ খসখসে আঁশের স্তুপের ভেতরে আবিষ্কার করবার পর বাইরে পায়ের শব্দ, কণ্ঠস্বর শোনবার পর, একটি কথাও নিজেদের ভেতরে তারা বলে নি। গত রাতের মাটি, কাদা, স্বেদে বীভৎস মূর্তি দুটি নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে বসে থাকে সারা দিন।
সন্ধে হয়ে যায়। মনে হয়, বাইরে উপস্থিত লোকের সংখ্যা একে একে কমে যাচ্ছে। তারপর, এক সময় বাইরেও অখণ্ড এক স্তব্ধতা ঝপ করে ঝুলে পড়ে।
এতক্ষণ দুজন দূরত্ব রেখে বসে ছিল, স্তব্ধতার নিঃশব্দ ঘণ্টাধ্বনির পর একই সঙ্গে তারা পরস্পরের কাছে এগিয়ে আসে, তাদের নিঃশ্বাসের গতি দ্রুততর হয়, হাতে হাত রাখে এবং উৎকৰ্ণ হয়ে তীব্ৰ অপেক্ষা করে।
কথা বলে বিলকিস প্রথম। অনেকক্ষণ নীরব থাকবার জন্যে তাঁর কণ্ঠস্বর বিকৃত এবং প্রেতলোকের মতো শোনায়। কানের কাছে মুখ রেখে সে বলে, আজ রাতেই শেষ করে ফেলতে হবে।
বাইরে, কবরটা ওরা আবিষ্কার করতে পেরেছি। কিনা, লাশের সংখ্যা কম দেখে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সিরাজকে জাগ্ৰত প্রতিটি মুহূর্তে শঙ্কিত এবং ভাবিত করে রেখেছিল। সন্ধের আগেই গুদামের ভেতর নিকষ অন্ধকার দেহ বিস্তার করে ফেলেছে। উদ্বিগ্ন হয়ে বিলকিসের দিকে তাকিয়ে সে আবিষ্কার করে, তার মুখ আর দেখা যাচ্ছে না। সেই আবিষ্কার মুহূর্তের ভেতরে তাঁর আত্মায় ফিরিয়ে আনে মৃত্যুর সান্নিধ্য, চিতার আগুন, কবরের মাটি এবং যোজন ব্যাপী নিঃশব্দ প্ৰবল ঘণ্টাধ্বনি।
সময় বয়ে যায়। পনেরো মিনিট কি পাঁচ ঘণ্টা, অথবা একটি জীবনকাল, বোধিতে ধরা পড়ে না।
বিলকিস সিরাজের পাশ থেকে উঠে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে কানে কানে বলে, ওদিকে টিনের একটা ফুটো দিয়ে দেখা যাচ্ছে। কোথাও কেউ নেই। ভালো করে দেখেছি। এই সময়।
দরোজার কাছ থেকে পাটের বেল দুটো আবার সেই পরিশ্রম করে সরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরোয় তারা। বেরিয়ে দরোজার পাশেই অন্ধকারে চুপ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। বাইরে খোলা হাওয়া জলের মতো তাদের ধৌত করে যায়। শরীরের সমস্ত ক্লোদ, ক্লান্তি, কাদার অনুভব নিঃশব্দে মুছে যায়। আবার পূত পবিত্র বলে বোধ হয় নিজেদের। একটু একটু করে হামাগুড়ি দিয়ে তারা এগোয়। গুদামের সমকোণ ঘুরে, সরু গলি পথ অতিক্রম করে, ঠিক বাজারের চত্বরের মুখে স্থির হয় তারা। বিলকিসই প্রথম মাথা বাড়িয়ে দেখে নেয় চত্বরটা।