দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিলকিস বলে, হয়তো এখানেই বাচ্চা দুটোর জায়গা হয়ে যাবে।
পায়ের দিকে কিছুটা জায়গা খালি আছে। সেদিকে তাকিয়ে সিরাজ বলে, আপনি উত্তর দিকে মাথা দিতে বললেন, বাচ্চাদের তো উত্তর দিকে হবে না।
না হোক।
সিরাজ তবু ইতস্তত করে।
দেরি করো না।
দুজনে বাচ্চা দুটোকে কোলে করে নিয়ে আসে খলপাড়ে। হঠাৎ চোখে পড়ে, দূরে কী জ্বলজ্বল করছে দুটো! এক পলকের জন্যে শীতল হয়ে যায় শিরদাঁড়া। পরীক্ষণেই বুঝতে পারে–শেয়াল। মৃতের সংখ্যা যেখানে বেশি সেখানে জীবিত দুজনকে সে অতটা ভয় করে নি। অথবা পশু তার রক্তের ভেতরে অনুভব করতে পেরেছে, এরাও প্রায় মৃত কিংবা অবসন্ন।
তাড়াতাড়ি কবরের ভেতরে বাচ্চা দুটোকে পায়ের কাছে শুইয়ে দেয় ওরা। ফিরে তাকিয়ে দেখে, শেয়ালটা সেখানে আর নাই। চারদিকে দৃষ্টিপাত করেও তার আর সন্ধান পাওয়া যায় না।
কবরের ভেতর থেকে উঠে আসে ওরা। ওপরে দাঁড়িয়ে বিলকিস বলে, তুমি কি জান, মাটি দেবার সময় কোন সূরা দোয়া পড়তে হয়?
সিরাজ চুপ করে থাকে কবরের ভেতরে শায়িত লাশগুলোর দিকে চোখ রেখে।
তুমি আল্লাহ বিশ্বাস কর?
সিরাজ বিলকিসের দিকে তাকায়। নিঃশব্দে কয়েকবার ঠোঁট কেঁপে ওঠে তার।
সিরাজ বলে, না।
বিলকিস সচকিত হয়ে সিরাজের দিকে তাকায়। তারপর নিজেই অনুভব করে তার নিজের ঠোঁট প্রসারিত হচ্ছে। বড় পরিচিত সেই সম্প্রসারণ–খুব ভেতর থেকে, সুদূর থেকে হাসি পেলে ঠোঁটের পেশিতে এই পরিবর্তন হয়।
বিলকিস বলে, তাহলে, আমরা না হয় বলি, যে মাটি থেকে এসেছিলে সেই মাটিতে ফিরে যাও।
ঝুঁকে পড়ে দুমুঠো মাটি তুলে নেয় দুজন। সযত্নে ধীরে কবরের ভেতর মাটি ঝরে পড়ে জীবিত দুটি মানুষের আঙ্গুলের ভেতর দিয়ে। হাত শূন্য হয়ে যাবার পরও অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারা।
সিরাজ?
দিদি।
হয় আমাকে আপা বল, না হয় দিদি! হাত চালাও, মাটি দিয়ে ভরে দিতে হবে না?
যতটুকু মাটি সদ্য খুঁড়ে তোলা হয়েছিল তাতে অর্ধেক কবর কোনো রকম ভরাট হয়। আবার তারা সেই টিনের টুকরো দুটি হাতে নেয়। পাড় থেকে ঢালু মাটি কেটে আনতে সুবিধে হয়। সেই মাটি এনে ভরে দিতে থাকে কবর।
ঠিক তখন পটপট করে গুলি শোনা যায়।
০৯. শ্রী প্রদীপ কুমার বিশ্বাস
সঙ্গে সঙ্গে পাড়ে ঢালুর ওপর ছিটকে উপুড় লম্বা হয়ে পড়ে বিলকিস আর সিরাজ। একবার মনে হয় খালের ওপার থেকে, আবার মনে হয় বাজারের দিক থেকে শব্দটা আসছে। শব্দ থেমে যায়, শব্দের অনুপস্থিতির ভেতরেও তারা দীর্ঘ অনুরণন শুনতে পায়। তারপর স্তব্ধতা ফিরে আসে।
কোথায়?
বুঝতে পারছি না।
গুলির শব্দ আর ফিরে আসে না। খালের অপর পাড়ে তাকিয়ে আগের মতোই সব কিছু মনে হয়। বাজারের দিকেও কোনো মানুষের সাড়া বাঁ পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না।
আস্তে গা ছেড়ে দেওয়াতে ঢালু বেয়ে কবরের পাশে এসে পড়ে তারা। সময় পেলে মাটি সমান করে দেওয়া যেত, কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। আক্রমণটা কোন দিক থেকে আসছে, আগে বুঝে দেখা দরকার।
এখানে থাকা বোধহয় ঠিক হবে না, সিরাজ।
গুলিটা কোনদিকে হলো, বুঝতে পারলে হতো।
আমার মনে হয় দূরে কোথাও।
খুব দূরে নাও হতে পারে।
এখনো অনেক লাশ বাকি।
খোকা ভাইকে পেলেও হতো।
খোকাকেও আমরা মাটি দেব, সিরাজ। ফিরে যাব না।
ভীত কণ্ঠে সিরাজ বলে, রাত তো বাকি নেই।
তাহলে কাল আবার আমরা শুরু করব।
কিন্তু এখান থেকে এখন চলে যাওয়া নিরাপদ হবে না।
এখানে?
হাঁ, এখানে। এত বড় একটা বাজার, একটা দিন লুকিয়ে থাকা যাবে না?
খুব মুশকিল হবে।
এর চেয়ে অনেক বড় মুশকিলের ভেতরে আমরা আছি। বাজার থেকে এখনো কোনো শব্দ পাচ্ছি না, আপা।
বিলকিস কান খাড়া করে এখনো শোনবার চেষ্টা করে।
বাজারে কেউ নেই।
তাহলে কী করবে?
আগে এসো, মাটি সমান করে দিই। কবরের। লাশের তাতে কোনো লাভ নেই। আমাদের মন বলবে, একটা কাজ আমরা ভালো করে শেষ করেছি।
আপা, আমার একটা কথা মনে এল।
কী, সিরাজ?
এত কুঁকি নিয়ে এলাম, কবর দিলাম, যারা মরে গেছে তাদের তো কোনো লাভ নেই।
নেই? কে বললে নেই?
আমি তো দেখি না।
ঐ যারা মরে গেছে, তুমি ওদের আলাদা করে দেখছ বলেই একথা বলতে পারছি। যদি মনে করতে পারতে ওরা তোমারই অংশ, তাহলে দেখতে ওদের সৎকার করে তুমি জীবনকে শ্রদ্ধা করছ, সম্মান দিচ্ছ।
টিনের সেই টুকরো দুটো দিয়ে কবরের মাটি সমান করে উঠে দাঁড়ায় ওরা। গলিপথে এসে থামে। তারপর সন্তৰ্পণে চত্বরের মুখে গিয়ে সতর্ক চোখে চারদিকে দেখে নেয়। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আগের মতোই সব মনে হচ্ছে। তবু সাবধানের সঙ্গে পা ফেলে। দোকানগুলোর গা ঘেঁষে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে যথাসম্ভব মিশে থেকে চলে।
কোথায় যাবেন?
আমি ঠিক করে ফেলেছি। এসো আমার সঙ্গে।
বাজারের চত্বরটা পেরিয়ে পাটগুদামের পাশে টিনের ঘরগুলোর ছায়ায় দাঁড়ায় বিলকিস। সেখান থেকে লাশগুলোর দিকে আবার পরিপূর্ণ সম্পূর্ণ চোখে সে তাকায়।
সিরাজ, যদি পারতাম, আজ রাতে আমি সবাইকে মাটি দিতাম। দেখতাম ওদের হুকুম কত বড়! ওরা দেখত আমরা পশু নই, আমরা আমাদের মৃতদেহ ফেলে রাখতে দেই না, আমরা শকুনের খাদ্য হতে চাই না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিলকিস আবার বলে, আমাদের দুটি করে মাত্ৰ হাত, লাশ তো অনেক।
এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন?
তাই তো।
আকাশ ফিকে হয়ে আসছে।
সিরাজ, এই পাট গুদামগুলোর কথা ভাবছিলাম। এর ভেতরে নিশ্চয়ই আমরা লুকিয়ে থাকতে পারব।