আলেফ মোক্তার লাইন করে দাঁড় করাবার কথা বলেছিলেন, মনে পড়ে যায়। নান্টু আর এরফানের লাশ–দেখে অনুমান করা যায়, এক লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাহলে খোকা কি লাইনে ছিল না। দ্বিতীয় একটি লাইন করা হয়েছিল। শুধু দুটি? তৃতীয় লাইন কি হয় নি?
আবার কিছু বিক্ষিপ্ত লাশ দেখে, তাদের হাতের কাছে ঝাকা, ব্যাগ, সবুজি দেখে মনে হয়, বেপরোয়া গুলি চলেছিল অকস্মাৎ। মানুষগুলো দৌড়ুতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিল।
কোনটা আগে হয়েছিল? লাইন করিয়ে গুলি, না, বাজারের জনতার ওপর গুলি?
আপা, খালপাড়ে একটা গর্ত করা আছে। আপনি দেখবেন?
দুসারি দোকানের ভেতর দিয়ে খালের দিকে গলি। কোনো দোকানে ঝাঁপ ফেলা নেই। ভেতরের তাক, আলমারি, আসন সব ভেঙেচুরে উল্টে, হা খোলা পড়ে আছে।
লুটও করেছে ওরা।
তা করবে না? এর আগেও দুবার লুট করেছিল।
বিলকিস এমনভাবে হেঁটে যায়, যেন ধরা পড়বার ভয় নেই। হয়তো ধরা পড়বার কথা সে ভুলে গেছে অথবা এতক্ষণে নিশ্চিত হয়েছে, বাজারে কেউ পাহারায় নেই।
সিরাজ যাকে গর্ত বলেছিল, ঠিক গর্ত নয়। খালপাড়ের ভাঙন ঠেকাবার জন্যে বাঁশের বেড়া লম্বা করে দেওয়া আছে। তবু ভেতর থেকে মাটি খসে যায় বলে মাঝে মাঝে মাটি কেটে ভরাট করতে হয়। সেই মাটি কেটে নেবার দরুন কিছুটা দূরে পাগারের মতো হয়ে আছে। তার ভেতর নেমে পড়ে বিলকিস। মাটিতে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে। মাটি ঝুরঝুরে নরোম বালির মিশেল।
উৎসুক চোখে সিরাজ তাকিয়ে থাকে বিলকিসের দিকে।
বিলকিস বলে, তবু একটা দিক আরো একটু খুঁড়তে হবে। ওদিকে গর্ত কম। তারপর সে গর্তের দৈর্ঘ্য-প্ৰস্থ একবার হেঁটে আসে। বলে, খুব হলে আট নজনের মতো জায়গা হবে। আরেকটা বড় কবর খুঁড়তে হবে যে!
আগে যেটা আছে, আমরা কবর দিয়ে নি?
তা ভালো।
সিরাজ ইতস্তত দৃষ্টিপাত করে। এমন একটা কিছু সে খোজে, যা দিয়ে গর্তটা গভীর করা যায়। কিন্তু কিছু চোখে পড়ে না।
বিলকিস বলে, বাজারে হয়তো পাওয়া যেতে পারে।
দুজনে আবার উঠে আসে চত্বরে। এ দোকান সে দোকান উঁকি দেয়, অন্ধকারে ভালো ঠাহর করা যায় না। কোদাল বাঁ খন্তা জাতীয় কিছুই চোখে পড়ে না। লাশগুলোও এখন আর তাদের নিশ্চল বাঁ স্তম্ভিত করে না। যেন এ ব্যাপারে অনেক আগেই একটা নিম্পত্তি হয়ে গেছে; লাশগুলো সহিষ্ণুভাবে অপেক্ষা করছে তাদের শেষকৃত্যের।
হঠাৎ টিনের একটা টুকরো পাওয়া যায়। আঁশটে গন্ধ। এমনকি মাছের আঁশ লেগে আছে। জেলেদের কেউ ঝাকার ওপর এই টিন বিছিয়ে মাছ বেচত।
এটাই বেশ।
সিরাজ সায় দেয়।
আরেকটা দরকার।
আঁশটে গন্ধ ধরে এগোতেই মাছ-এলাকায় এ রকম আরো কয়েকটা টিনের টুকরো পাওয়া যায়। দুজনে টিন দুটো নিয়ে তরতর করে ফিরে যায়। খালপাড়ে।
যতটা সহজ মনে হয়েছিল, মাটি যত নরম মনে হয়েছিল, ঠিক তা নয়। বালির পাতলা স্তরের পরেই কালো শীতল এঁটেল মাটির পুরু স্তর। সর্বাঙ্গে মাটি-কাদা মাখামাখি হয়ে যায়। তবু একরোখার মতো দুজনে গর্ত গভীর করে চলে। চাঁদ কখনো আলো দেয়, কখনো মেঘের আড়ালে কৃপণ হয়ে যায়।
আধা ঘণ্টাখানেক খুঁড়বার পর বিলকিস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, এই থাক।
এতক্ষণে টের পায়, পিঠ টনটন করছে। গর্তের খাড়াইতে বসে পড়ে বিলকিস। বসে। হাঁপাতে থাকে। সিরাজও এতক্ষণ পরিশ্রম করে ঘামে ভিজে উঠেছিল। এক হাতে কপালের ঘাম মুছে সেও বসে পড়ে।
বিলকিস বলে, লক্ষ করেছ সিরাজ, সারা বাজারে কটা পাহারা নেই?
হাঁ, তাই দেখছি।
সিরাজ তবু সাবধানী দৃষ্টিপাত করে চারদিকে। খালের অপর পাড়েও দেখে নেয় সে। ফসলের মাঠের পর কালো ফিতের মতো অন্ধকার গাছপালার সার।
হুকুম শুনে মনে হয়েছিল, দিনরাত পাহারা দিয়ে আছে।
আশ্চর্য!
কীসের আশ্চৰ্য, সিরাজ? রাতের অন্ধকারকে ওরা ভয় করে।
সিরাজ তবু সতর্কতা ত্যাগ করে না। ঘন ঘন সে মাথা ফিরিয়ে ডানে-বায়ে দেখে নিতে থাকে।
বিলকিস উঠে দাঁড়িয়ে বলে, যেখানে সবচে কঠিন হুকুম জারি করেছিল, সেখানেই ওদের সবচে বেশি ভয়।
আমার মনে হয়, তবু আমাদের তাড়াতাড়ি করা দরকার।
সিরাজও উঠে দাঁড়ায়।
খালপাড়ে উঠে গিয়ে নিচে কবরটার দিকে ফিরে তাকায় দুজনে। গর্তের শূন্যতাকে বাস্তবের চেয়েও অনেক গভীর এবং ব্যাপকতর বলে বোধ হয়।
গলিটা চত্বরে গিয়ে পড়বার মুখেই একটা লাশ কাৎ হয়ে পড়েছিল। মধ্যবয়সী গরীব কোনো রমণী। খাটো শাড়ি হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে। বুক খোলা। নিচের চোয়াল বিকৃত হয়ে এক পাশে ঠেলে সরে গেছে। রুক্ষ চুলে আধখানা ঢেকে আছে তার মুখ।
নীরবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যায়। রমণীটিকে দিয়েই শুরু করে।
সন্তৰ্পণে, যেন এখনও প্ৰাণ আছে–ব্যথা পাবে, বিলকিস রমণীর হাত দুটি মুক্ত করে নেয়, পাঁজরের নিচ থেকে।
তুলতে পারলে ভালো হতো।
তোলা মুশকিল হয়ে পড়ে। মানুষ মৃত্যুর পরে ভারী হয়ে যায়। আত্মাই মানুষকে লঘু রাখে। যতক্ষণ সে জীবিত, পাখির মতো উর্ধে উঠে যাবার সম্ভবপরতাও তার থাকে। প্ৰাণ এবং স্বপ্নের অনুপস্থিতিতে মানুষ বিকট ভারে পরিণত হয়। লাশটিকে তখন টেনে নিয়ে যায় ওরা, আস্তে আস্তে গলিটা পার হয়ে ঢালু বেয়ে নিচে নামে। তার পর গর্তের এক প্রান্তে শুইয়ে রেখে আবার ওরা ফিরে যায় চত্বরে। আবার একটি লাশ আনে। প্রথমে যাকে পায় তাকেই আনে। এমনি করে করে ছটি লাশ নামিয়ে আনে তারা। বিলকিস অনুমান করেছিল আট নজনের মতো সংকুলান হবে। দেখা যায়, ছজনেই আর জায়গা নেই। তখন মুহূর্তের জন্য অবসন্নতা পেয়ে বসে দুজনকেই। মোট কত লাশ গুণে দেখে নি, কিন্তু এর চেয়েও অনেক বড় কবরের যে দরকার হবে, তা তারা অনুভব করে।