না। নেই।
কী করে বুঝলেন?
একটা শিয়াল দৌড়ে গেল। শেয়াল মানুষ থাকলে আসত না।
সিরাজ কান খাড়া করে। কিছু শুনতে পায় না কোথাও। কেবল খালপাড়ে জলের মৃদু অনবরত অভিঘাত বেজে চলে। শ্রুতির ভেতর যতটা নয়, আত্মার ভেতর দিয়ে জলের সেই শব্দ বয়ে যায়।
তবু সাবধান হবেন না?
আবার চারদিকে তাকায় সিরাজ।
জানেন, ওরা লুকিয়ে থাকতে পারে? হুকুম দিয়েছে লাশ কেউ ছুঁতে পারবে না। কাছে এলেই গুলি করবে।
জানি।
ওরা কি একা ফেলে রেখেছে, মনে করেন? কখনো না।
তুমি ফিরে যাও, সিরাজ।
আপনি?
আমি খোকাকে খুঁজে বের করব। নিজের হাতে মাটি দেব।
চাঁদ মুক্ত হয়ে যায়। যখন তারা চত্বরের দিকে তাকায় কাফনের মতো ধবধব করে সবকিছু। বিলকিস বলে, আমার মৃত্যুভয় নেই। সিরাজ। আমি পারব ওদের হুকুম উপেক্ষা করতে। সিরাজ কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, আপা, আপনি মনে করেন, প্ৰাণের আমার মায়া আছে? আমার বাবাকে ওরা মেরে ফেলে নি, আমার বোনকে ওরা নিয়ে যায় নি?
সিরাজের কাঁধে হাত রাখে বিলকিস। চুপ। কাঁদতে নেই।
আমি কাঁদছি না। আমি আর একটা বোন হারাতে চাই না।
বিলকিস এক মুহূর্ত সময় নেয় কথাটা বুঝতে। তারপর সিরাজকে বুকের কাছে টেনে নেয়। ছিঃ কাঁদে না। কাঁদতে নেই। আমি কি চাই না। আমার ভাই আমার সঙ্গে থাকবে, আমরা এক সঙ্গে খোকাকে কবর দেব?
বাজার সড়কের শেষ বাঁকে, পাট গুদামের সারিগুলো পেরিয়ে, ব্যাপারিদের টিনের আপিসঘর ছাড়িয়ে চত্বরটা চোখে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব যে দুলে উঠেছিল। এতক্ষণে তা স্থিরতর হয়।
যেন দূরের একটি লক্ষ্যস্থল স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল হয়ে যায়।
বিলকিস আর সিরাজ নিঃশব্দে চত্বরে নামে।
বিলকিস ফিসফিস করে বলে, তুমি ঠিক বলেছ, ধরা পড়ে গেলে খোকাকে কবর দিতে পারব না।
আপা দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। বসে পড়ি।
ধরা পড়তে চাই না, সিরাজ। আমরা ধরা পড়তে চাই না। ধরা না পড়ে, খোকাকে কবর দিয়ে, আমি দেখিয়ে দিতে চাই, খোকা মানুষ, খোকা পশু নয় যে তার লাশ পড়ে থাকবে।
বিলকিস কথাগুলো একটানা বলে না। থেমে থেমে বলে, আর হামাগুড়ি দিয়ে একেকটা লাশের কাছে যায়। তার মুখ ফিরিয়ে দ্যাখে, আবার নিঃশব্দে নামিয়ে রাখে। সব লাশের কাছে যায় না। মুখ না দেখেও বোঝা যায়। পোশাক দেখে অনুমান করা যায়, খোকা নয়, দোকানদার, বাজারের কুলি, গ্রামের গৃহস্থ।
দূরে একটা লাশ দেখে দুজনেই একসঙ্গে সচকিত হয়ে ওঠে।
পরনে ট্রাউজার, গায়ে হাফশার্ট, পেটে হঠাৎ ব্যথা উঠলে মানুষ যেভাবে যন্ত্রণায় উপুড় হয়ে পেট চেপে ধরে, অবিকল সেই ভঙ্গিতে পড়ে আছে। তার শরীরের গড়ন দেখে যুবক মনে হয়।
খোকা?
মুখ দেখে আর্তনাদ করে ওঠে সিরাজ।
কে?
এরফান।
আস্তে করে মাথাটা নামিয়ে রাখে বিলকিস।
ভালো ফুটবল খেলত এরফান। ফুটবলের জন্য পড়া হয় নি। বাজারে লাইব্রেরি দিয়েছিল।
অদূরে আরও একটি যুবকের লাশ চোখে পড়ে। তার মুখ পোশ ফেরানো। বুকের কাছে পা ভাঁজ করে, শীতের দিনে পাতলা কাঁথার নিচে শুয়ে থাকার মতো গুটিশুটি হয়ে আছে। একটা হাত, যেটা ওপরে, পেছনের দিকে টানটান প্রসারিত।
নান্টু।
কোন বাড়ির?
ভোলা ডাক্তারের বড় ছেলে। বিলকিসের মনে আছে ভোলা ডাক্তারকে। ছোটবেলায় কত ওষুধ খেয়েছে তার। বায়না ধরলে মাঝে মাঝে ছোট শাদা মিষ্টি বড়ি দিতেন খেতে। জলেশ্বরীর সবচে নামকরা হোমিওপ্যাথ।
বিলকিস বলে, নাটুকে কতদিন দেখি নি!
নান্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বিলকিস। আবার ঝুঁকে পড়ে দ্যাখে। আলতো একটা হাত রাখে নান্টুর গালে। তার বিস্ময় যায় না, সেই ছোট্ট নাটু কত বড় হয়ে গেছে! দাড়ি কামায় এখন। মুখের আদালটা একটু একটু করে স্মৃতির ছোট ছেলেটির সঙ্গে মিলে যায়।
নান্টু এত বড় হয়েছিল?
সিরাজ এতক্ষণ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল। নাটুকে সে এভাবে দেখতে পারছিল না। মুখ ফিরিয়ে রেখেই সে অবরুদ্ধ গলায় বলে, সময় চলে যাচ্ছে, আপা।
দাঁড়াও। নাটুকে ভালো করে শুইয়ে দি।
তারপর হামাগুড়ি দিয়ে আঁধারে আবার তারা এগোয়। খোকাকে তবু পাওয়া যায় না। সিরাজ, খোকাকে ওরা নিয়ে যায় নি তো?
না। মনে তো হয় না।
খোকা সত্যি এখানে ছিল?
মকবুলদা, আলেফ মোক্তার, দুজনেই বলেছেন। আলেফ মোক্তারকে, বললাম না, ওরা কী করতে বলেছিল?
লাফ দিয়ে ক্ৰোধ ফিরে আসে। সটান হয়ে দাঁড়ায় বিলকিস।
সিরাজ, শোনো।
বিলকিসের কণ্ঠস্বরে কী ছিল, ভয় পেয়ে যায় সিরাজ।
সে উঠে দাঁড়াতেই বিলকিস তার হাত শক্ত করে ধরে, সিরাজ, আমরা সবাইকে কবর দেব। হাঁ, সবাইকে।
খোকা ভাইকে খুঁজব না?
খুঁজতে হবে না। খোকা এখানেই আছে। একটার পর একটা কবর দিতে দিতে খোকাকেও আমরা পেয়ে যাব।
দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নীরবতা প্রথম ভাঙ্গে বিলকিস। আগে একটা জায়গা দেখতে হয়।
উল্লেখ করতে হয় না, কীসের জায়গা।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে সিরাজ বলে, বেশি দূরে তো যেতে পারব না খালপাড়ের মাটি নরম আছে। সেখানে কবর দিলে আপনাদের কোনো কিছু অশুদ্ধ হবে না তো?
বিস্মিত হয়ে বিলকিস সিরাজের দিকে তাকায়–আমাদের মানে?
হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে সিরাজ। থতিমতো খেয়ে বলে, আমি ঠিক জানি না। কবর কীভাবে দেয়। গোরস্তানে যেতে পারব না, তাই বলেছিলাম। খালপাড়ে কবর দিলে অসম্মান হবে। কিনা, আর কিছু না। আচ্ছা, আমি না হয় দেখে আসি।
সিরাজ গলি দিয়ে খালপাড়ের দিকে চলে যাবার পরও বিস্ময়টুকু তীক্ষ্ণ হয়ে থাকে। তারপর চত্বরের দিকে চোখ পড়তেই বলবান বাস্তব সমস্ত কিছুকেই পরাজিত করে ফেলে মুহূর্তে। লাশগুলোর পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখে মনের ভেতরে ছবি তুলতে চায় বিলকিস, আজ দুপুরে কী হয়েছিল।