দুপুরবেলায়?
কখন ঠিক জানি না।
কিছুক্ষণ শূন্যতার ভেতরে নিক্ষিপ্ত থেকে বিলকিস জিগ্যেস করে, উনি দেখতে পান না। কেউ তাকে বলেছে গুলির কথা। কে বলেছে?
প্রশ্ন করে সিরাজের কাছে উত্তর আশা না করে সে উঠে দাঁড়ায়।
কোথায় যাচ্ছেন?
ওর কাছে শুনতে চাই।
আর কী শুনবেন? বিহারীরা বিকেলবেলায় ওকে কোমরে দড়ি পরিয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। বাজারে। সেখানে ওরাই ওকে বলে ছেলেদের নাম।
ঠিক তখন দরোজার কাছে এসে দাঁড়ান আলেফ মোক্তার। হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে ভেতরে এগিয়ে আসেন। তিনি। বিলকিস উঠে তার হাত ধরে। বিছানায় নিয়ে আসে।
আলেফ মোক্তার কাতর একটা আহি ধ্বনি করে নীরব হয়ে যান। তাকে কিছু জিগ্যেস করবার মতো নিষ্ঠুর হতে পারে না বিলকিস।
অনেকক্ষণ পরে আলেফ মোক্তার বলেন, এত বড় পাষাণ, মানুষের অন্তঃকরণ নেই, হুকুম দিয়েছে, লাশ যেখানে আছে সেখানে থাকবে। কেউ হাত দিতে পারবে না। কচি ছেলেগুলোকে কাক শকুনে ছিঁড়ে খাবে, দাফন হবে না।
কে হুকুম দিয়েছে?
মিলিটারি। মিলিটারি ছাড়া হুকুম দেবার আছে কে?
তাদের মরতে হবে না কোনোদিন? তাদের মাটি দেবার দরকার হবে না কোনোদিন? ছেলেদের প্রাণ নিয়েছিস, মায়ের কোল খালি করেছিস, মায়ের মতো মাটি, তার কোলে রাখতে দিবি না। এজিদের দল? যেখানকার লাশ সেখানে থাকবে? মাটি সর্বত্র, মুখের দল। মাটি তাদের নিজের বুকে টেনে নেবে। আল্লাহর ফেরেশতা দাফন করবে। ফেরেশতার কাছে তোর হুকুম টিকবে না।
খসখসে গলায় বিলাপ করে চলেন আলেফ মোক্তার।
তার সে বিলাপ সহ্য করা যায় না। কিন্তু চুপ করতে বলবে, মনে হয় বাতাস হাহাকার করছে, অন্ধকার বিলাপ করে চলেছে। মানুষের সাধ্য নেই তা থামিয়ে দেয়।
এক সময়ে নিজেই তিনি চুপ করে যান। কেবল শোঁ শোঁ করে কষ্টকর শ্বাস নেবার শব্দ ওঠে।
সিরাজ।
আপা।
বারান্দায় এসো।
বাইরে এসে জিজ্ঞাসু চোখে সিরাজ বিলকিসের দিকে তাকায়। সিরাজ, তুমি বলছিলে না, মিলিটারি রাতে বেরোয় না?
কেন?
আমি যাব। বাজারে যাব। খোকার লাশ না দেখলে বিশ্বাস হবে না, খোকাকে আমি দেখব। তাকে আমি নিজের হাতে মাটি দেব।
কুথাটা শুনে চঞ্চল হয়ে পড়ে সিরাজ।
তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
০৬. মনসুর
বিলকিসের গলায় নিষ্কম্প ঋজু উচ্চারণ শুনে সিরাজ ভীত হয়ে পড়ে।
যাবে কি যাবে না?
এ একেবারে অসম্ভব কথা আপা।
তুমি না যাও, আমি একাই যাব।
সিরাজ তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আমার কথা নয়। আমার জন্যে বলছি না। যাওয়াই সম্ভব হবে না। খোলা জায়গা। বিহারীদের চোখে পড়ে যাবেন।
তাই বলে, আমার মায়ের পেটের ভাই, তার দাফন হবে না, আমি চুপ করে থাকব?
আপনি শুধু শুধু পাগলামি করছেন।
আমি যাব, সিরাজ।
ওরা দেখামাত্র গুলি করে। করুক।
আমার লাশও পড়ে থাকবে।
এতক্ষণ যে বিলকিসকে সিরাজ জানত, এখন অন্য কেউ মনে হয়। এমন কেউ যে একটা প্রবল ঝড়ের ভেতর স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
সিরাজ কিছুক্ষণ চিন্তা করে। সন্ধের সময় বিলকিসকে রেখে যখন খবর নিতে বেরিয়েছিল, তখন কেবল আলেফ মোক্তার নয়, মিষ্টি দোকমানের মকবুলদার কাছেও শুনেছিল, লাশ যেখানে আছে সেখানে পড়ে থাকবে, কেউ ছোঁয়া দূরে থাক, কাছে গেলে পর্যন্ত গুলি করা হবে। কৌশলটা আতঙ্ক সৃষ্টি করবার জন্যে, না লাশের নিকটজন কারা আসে তাদের ধরবার জন্য, স্পষ্ট নয়।
তোমার যদি ভয় করে, সিরাজ তুমি না হয় থাক, আমি একাই যাব। ঢাকা থেকে ভাইয়ের মরবার খবর শোনার জন্য যদি এসে থাকি তো তার মরা মুখও আমি দেখে যাব, নিজের হাতে মাটি দেব।
বেশ দেবেন। আপনার ভয় না করলে আমার কী? কথাটা বেপরোয়া শোনাতে পারত। শোনাল কিন্তু অভিমানকম্পিত।
বিলকিস তার হাত ধরে জলচৌকির ওপর বসায়। তারপর বলে, মোক্তার সাহেব কী করছেন, দেখা দরকার।
উঠে ভেতরে যায় সে।
কাটা একটা গাছের মতো পড়ে আছেন তিনি। মুখের ওপর ঝাঁকে দেখে, ঘুমিয়ে গেছেন। মরে যান নি তো? বুকের পরে আলতো করে হাত রাখে বিলকিস। খুব ধীরে শ্বাস বইছে। হৃৎপিণ্ডের সংকোচন বিক্ষোভ অত্যন্ত নিচু পর্দায় চলছে। তাঁর মুখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে সে। বাবার কথা মুহূর্তের জন্যে মনের ভেতরে নড়ে ওঠে। আবার শান্ত হয়ে যায়।
বিলকিস বাইরে এসে সিরাজের পাশে বসে।
কখন বেরুলে ভালো?
আরো কিছু পরে। দুপুররাতের দিকে।
তখন ওরা টহল দেয় না? রাতদুপুরের পরে বড় একটা না। বিহারী হোক, আর মিলিটারির যত চেলাই হোক, ওদেরও তো ভয় আছে।
কীসের ভয়?
বারে, দেখছেন না চোখের সামনে পুলে ডিনামাইট মেরে গেল? রাতেই ওরা আসে। অন্ধকারের সঙ্গে মিশে থাকে। ছায়ার মতো চলাফেরা করে। হামলা করে কোথায় মিশে যায়। কেউ বলতে পারে না।
খোদ ঢাকাতেই তার প্রমাণ পেয়েছে বিলকিস। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে খবরে শুনেছে।
সিরাজ বলে, সেই রাগেই তো আজ এতগুলো খুন করল। এর প্রতিশোধ দেখবেন ওরা নেবে।
ছেলেটির ভয় অনেকটা কমে গেছে। তার কথা শুনলে মনে হয়, পারলে সে এক্ষুণি প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বিলকিস বলে, আচ্ছা সিরাজ, একটা কথার উত্তর দেবে? এত ঝুঁকি নিয়ে আমার সঙ্গে জুটে গেলে কেন? আমি সত্যি চাই না, আমার জন্যে তোমার কোনো বিপদ হোক। অনেক করেছ তুমি।
বিলকিস সমোহে তার হাতে কয়েকবার চাপড় দেয়। আসলে সে বুঝে দেখতে চায়, কাঁচা বয়সে মেয়েদের জন্য মোহ থেকেই সিরাজ এত বড় ঝুঁকি নিতে চাইছে কিনা। তা যদি হয় তার উচিত হবে না। তাকে প্রশ্ৰয় দেয়া।