এবারে আবিদ না করতে পারেনি। আশরাফ ব্যবসা সূত্রে ঢাকায় আসা যাওয়া করত। সেই থেকে জাকির সাথে আলাপ তার ফার্মে। তারপর আশরাফ আর আবিদ এসেছিল তাহমিনাকে দেখতে। সেই দিনেই বিয়ের কথা ঠিক হয়ে যায়। এত তাড়াতাড়ি যে হয়ে যাবে। তা কেউ ভাবতে পারে নি।
মালকাবানু উঠে গিয়ে আবিদের ছবি এনে দেখালেন।
তারপর তিনি আবার বললেন, ফারুক বিয়ের সময়ে ঢাকায় থাকলে খুশি হতেন। কিন্তু ফারুক উত্তর সেই একই দিয়েছে।
উঠে আসবার সময় পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে এসেছে ফারুক। দোয়া করুন তিনি, চাকরিতে যেন তার ভালো হয়। মালেকাবাণু প্রাণ খুলে প্রার্থনা করলেন আল্লার দরগাহে। গেটের কাছে এসে ফারুক অনুভব করতে পারল অন্ধকার বারান্দায় তাহমিনা এসে দাঁড়িয়েছে। সে আর তাকাল না।
০৭. হপ্তা দেড়েক আগে সেদিন
হপ্তা দেড়েক আগে সেদিন বন্দুক নিয়ে বেরিয়েছিল আবিদ। তাহমিনা সেদিনও বাধা দিয়েছিল, না আজ যেও না। কিন্তু নিষেধ সে শোনেনি। বেরিয়ে গিয়েছিল। আর বিকেলেই সবাই ধরাধরি করে নামিয়ে এনেছে অচৈতন্য আবিদকে। হরিয়াল টিপ করেছিল ও। আর সেই হরিয়াল ডানা লুটিয়ে ঝুপ করে পড়ে গিয়েছিল নদীতে। এত বড় সুন্দর হরিয়াল নাকি সচরাচর মেলে না।
উত্তেজনায় ওটা ধরবার জন্য নিজেই যখন সে নদীতে নেমেছে তখন একটা কুমির জলের অতল থেকে ভেসে এসে ওর পা কামড়ে ধরেছিল। আর সে কী যমে মানুষে টানাটানি। চোখের পলকে যে কী হয়ে গেল তা কেউ ঠাহর করে উঠতে পারে নি। মেমসায়েবের কপাল ভালো, সায়েবের হায়াত দারাজ; অবশেষে আদালী আর মাঝিরা মিলে অসাধ্য সাধন করেছে। ডান পা দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরছে তখন। খুবলে নিয়েছে মাংস। আর আবিদ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
একটা বার্নিশ করা প্রশস্ত খাড়াপিঠ চেয়ার টেনে দিয়েছে আবিদের বেয়ারা আবদুল। খুলে দিয়েছে বাংলার জানালার শার্সী। সেখানে রাত্রি চোখে আসে। ফারুক পিঠ সোজা করে খানিকটা উবু হয়ে ঝুঁকে পড়ে কথাগুলো শোনে। আর একটা হারিকেন জ্বালতে জ্বালতে আবদুল বলে চলেছে, অজ্ঞান হয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ। বাংলোতে নিয়ে এসে ওষুধ দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করে দেয়া হলো পা। সন্ধ্যেয় একবার জ্ঞান ফিরেছিল। কিন্তু রাত্রে এলো বেহুশ জ্বর। এমন সে জ্বর যে ধান দিলে খৈ হয়ে যায়। আর ভুল বকতে লাগলেন শুধু। —-এইখানে একটু থেমে দেশলাই নেভাতে নেভাতে সে বলল, শুধু মেম সায়েবকে বকতে লাগলেন। প্রলাপে, খুন করে ফেলেন আর কী।
ফারুক শুধালো তারপর?
তারপর, সকালে মেনসায়েবকে নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে এসেছি। এখন আল্লা মালেক।
ফারুক একটু আড় হয়ে বসলো চেয়ারে। তাকিয়ে রইল বাতাস দোলানো হারিকেন শিখার দিকে।
হাসপাতালে আবিদকে রেখে সেদিনই সন্ধ্যেয় তাহমিনা ফিরে এসেছে বাংলোয়। কাল আবার খবর পেয়ে গেছে সদরে। এখনো ফেরেনি। আবদুলের হারিকেন জ্বালানো শেষ হলো। সলতে একটু উঁচিয়ে নিয়ে ও বেরিয়ে গেল একটু সামনের দিকে ঝুঁকে।
ফারুক তেমনি বসে রইল অনেকক্ষণ। বাইরের প্রান্তর কেমন অদ্ভুত আবছা লাগছে। কেন সে এসেছে এখানে? অরণ্যের বাংলোতে? প্রেতের ডানার রং যেন চারদিকে। ফারুকের সমস্ত কিছু মিলিয়ে গেল, মিশে গেল। যুক্তি বুদ্ধি বিশ্বাস সবকিছু। শুধু কি এরই জন্য তাহমিনা তাকে ডেকে এনেছে এতদিন পরে ঢাকা থেকে? কেন সে ডাকল না তার ভাইকে, যদি আবিদের বিপদটাই মুখ্য হয়?—-ফারুক তাকে কী দিতে পারে?—-কী করতে পারে সে? —-সে ভাবল।
গোটা পৃথিবীতে যেন কেউ নেই। তাহমিনা নেই, আবিদ নেই। কেউ না। একেলা এই বাংলোয় সে একা। একেল এক অরণ্যের রাত্রি নিঃসঙ্গতায় পূর্ণ। এ বাংলোয় বুঝি আর কেউ থাকে না। আর কারো সাড়া নেই। এ অরণ্যে বুঝি মানুষ থাকে না। ফারুকের মন ভয়ে ভরে উঠল। ঠিক ভয় নয়, সূক্ষ্ম একটা উদ্বেগ মাত্র। আর সেটাই তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল এখন। এইমাত্র যে আবদুল ছিল তার সমুখে দাঁড়িয়ে তাও কেমন অবিশ্বাস্য মনে হলো। ফারুক মুখ ফিরিয়ে নিল জানালা থেকে। এমন সময় আবদুল ফিরে এল, হুজুর।
কে, আবদুল? ও।
আসুন হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলাবেন না? বাথরুমে পানি দিয়ে এসেছি।
ফারুক চুপ করে রইল। আবদুল বলল, মেমসায়েব কাল ভোরেই এসে যাবেন। আপনি কিছু ভাববেন না। এখন আসুন।
আবদুল, আমি এখুনি ফিরে যাচ্ছি।
হুজুর! বিস্মিত হলো আবদুল তার এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে।
হ্যাঁ এখুনি। একটা নৌকো ডেকে দাও ঘাটে লঞ্চ পাবোই। আর তোমার মেমসায়েব এলে আমার সালাম দিও।
হুজুর অসুবিধেটা কি, ঠিক
না, না, তার জন্যে নয়।
সায়েবের একটা কিছু খবর না নিয়ে—-
আবদুল তবু ধরে রাখতে চাইল। কিন্তু ফারুক বাধা দিল। উঠে দাঁড়াল। বলল, বোধ হয় বাংলো ফেলে তুমি যেতে পারবে না। কাছে ভিতে কোনো লোক থাকলে সাথে দাও। তার দরকার হবে না। আমি নিজেই আসছি। কিন্তু এই রাত বিরেতে না বেরিয়ে থেকে গেলেও পারতেন হুজুর!
একটা সিগারেট ধরিয়ে ফারুক উত্তর করল, সে হয় না আবদুল।
আবদুল নীরবে সুটকেশগুলো হাতে তুলে নিল। দরোজায় লাগিয়ে দিল তালা। তারপর মুখে বলল, বেশ চলুন।
কিন্তু ডান দিকের করিডর ঘুরে সামনের বারান্দার ভাঁজে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল ফারুক। যেন ভীষণ একটা কিছু সে দেখেছে। এক পাও নড়তে পারল না। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দুর্বোধ্য দুএকটা শব্দ গড়িয়ে পড়ল শুধু।