না রাগ করব কার ওপর? কিন্তু জানো তাহমিনা, সত্যি করে বলছি, তোমার হাত ছুঁয়ে বলছি, তুমি যেখানেই থাকো যার কাছেই যাও, চিরকাল তোমার কথা আমি মনে করব। কোনদিন ভুলব না।
তুমি মনে কর তোমাকে আমি ভুলে যাবো?
কী জানি।
না আমি ভুলব না ফারুক।
তুমি ভুলে যাবে তাহমিনা। না মিনু, যে মনে রাখা পাপ, তা ভুলে যাওয়াই ভালো।
দুজনেই চুপ করে ভাবল খানিক। এক সময় তাহমিনা বলল, এখন কেমন আছো?
ঠিক তেমনি।
ফারুক নির্লিপ্ত সুরে অন্যমনে উত্তর করল তার।
কক্সবাজারে গিয়েও ভালো হলো না?
কিছুটা। কিন্তু ওকথা তুমি শুধিও না তাহমিনা।
কেন ফারুক?
তুমি কি তা বোঝো না?
বুঝি। এ অধিকারও তুমি আমার মুছে দেবে?
আমি তো কেউ নই মিনু।
তাহমিনা কোনো কথা বলল না এর জবাবে। শুধু মাথা নিচু করল একবার, উবু হয়ে ঝুঁকে পড়ে ঠিক করে নিল স্যাণ্ডেলের স্ট্র্যাপ। কেউ তাকে বুঝবে না। তারপর আবার সেই নিস্তব্ধতা। নিশ্চল দুজনে। যেন দুজনের কথাই ফুরিয়ে গেছে। চুপ করে থাকা ছাড়া যেন আর কোন ভাষা নেই। তাহমিনা আর ফারুক মুখোমুখি তেমনি গভীর নীরবতায় ডুবে রইল। বহুক্ষণ সেই কেবিনে। ফারুক মাথা তুলে বলল, আমি কোনদিন ভাবিনি এমন হবে। প্রথম এসে যখন শুনেছি তখন যে আমার কী হয়েছিল তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না তাহমিনা। আজ গিয়েছিলাম দেখা করতে তোমাদের ওখানে। কিন্তু মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছি। কেন জানো? তোমাকে আমি বিব্রত করতে চাইনি, তুমি যে আমার আপন। দৈবে দেখা না হলে হয়ত আর কোনদিন আমাদের দেখা হতো না। ফারুকের স্বর শোনাল ফিসফিস, যেন স্বগত উচ্চারণ করছে সে। এখানে সে একটু থামল। তারপর বলল, তুমি আমাকে কিছুই লিখলে না কেন তাহমিনা?
তাহমিনার গলা ভারী হয়ে এলো। উত্তরে বলল, তুমি মনে কর এ বিয়েতে আমি খুশি হয়েছি? ফারুক চুপ করে রইল।
তোমার যা খুশি মনে করতে পার ফারুক, দুঃখ রইল, বুঝলে মা। আমি কী করে তোমায় লিখতাম? কী করতে পারতাম? আর সে কিছুই উচ্চারণ করতে পারল না। চোখ নামিয়ে নিল।
পর্দা সরিয়ে এলো বেয়ারা নিয়ে গেল রেকাবি আর গ্লাশ। তাহমিনা বারেক চোখ বুজলো। ফারুক এতক্ষণ পরে একটা সিগারেট ধরালো। ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে অ্যাসট্রেতে ডুবিয়ে দিল কাঠিটা। বলল, যাবার সময় হয়ে এল তাহমিনা। তুমি ভুল বুঝবে না। দোষ আমি কাউকে দেব না। তুমি কি করতে পারতে? সে আমি জানি। চল উঠি।
হ্যাঁ।
এই হয়ত আমাদের শেষ দেখা।
তাহমিনা চোখ নিচু করে বই ভ্যানিটি ব্যাগ গুছোলো। তারপর বলল, একটা কথা তোমায় বলব?
বলবে।
আমার কথা তুমি মনে রেখ। কোনদিন যে চিনতে সে কথা মনে রেখ।
সেও আমার পাপ। এ অন্যায় মিনু।
আর, যদি কোনদিন আমাদের দেখা হয়, তাহলে বলো মুখ ফিরিয়ে নেবে না।
আমি কিছুই বলতে পারছি না তাহমিনা। আমি কিছুই বলতে পারছি না।
একটু পরে ও বলল, মা তোমাকে ডেকেছিলেন। একবার যেও। শুনেছেন তুমি শীগগীরই ফিরবে।
কেন?
জানি না।
এরপর আর কোনো কথা হয় নি তাদের। দুজনে যখন উঠে দাঁড়িয়েছে তখন হঠাৎ পরস্পর থমকে দুজনের মুখের দিকে অপলক তাকিয়েছে। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। আর সেই এক পলেই যেন কেটে গেল এক বিশাল সময়। তাড়াতাড়ি পা বাড়ালো তাহমিনা। পেছনে এলো ফারুক। আর তারা কথা বলল না। আর কেউ কারো দিকে তাকাতে পারল না।
.
কয়েকদিন পরেই সে গিয়েছিল তাহমিনাদের বাসায়। তাহমিনা ছিল বাসাতেই। কিন্তু সমুখে আসেনি। মালেকাবাণুও প্রথমে কিছুই বলেন নি ওর বিয়ের কথা। ঠিক আগের মতই আদর করে চা করে এনে দিলেন ফারুকের জন্য। বসে বসে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছিলেন। আর তার অসুখের কথা।
ফারুক জানতো একসময় সেই কথা উঠবে, আর তখন সে কি পারবে নিজেকে ধরে রাখতে? বিয়েতে এসো ফারুক। আসবে তো?
এত মিষ্টি করে তিনি বলেছিলেন যে তা আজো সে ভুলতে পারবে না। আর তার স্বর এত স্নেহগভীর যে সে বিস্মিত হয়েছিল। কিন্তু উত্তরে মিছে করে বলেছে, ঢাকায় সে তখন থাকবে না। সিলেটের এক চা বাগানে কাজ পেয়েছে, এ মাসেই জয়েন করবে। মালেকাবাণু আর কিছু বলেন নি ওকে। তার কাছ থেকেই ফারুক শুনলো, তাহমিনা অনার্স ছেড়ে দিয়ে পাস দিচ্ছে। আর শুনলো আবিদের কথা।
সুন্দরবনের টিম্বার মার্চেন্ট আবিদ চৌধুরী, তার দাদার সময় থেকে এই কারবার ছিল বার্মায়। বাবা তার সম্প্রসারণ করেছিলেন সুন্দরবন অবধি। বিয়াল্লিশের বোমার পর বার্মা ছেড়ে তিনি চলে আসেন। আবিদ রেঙ্গুনে নি এম.কম পড়ত। সমস্ত পরিবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বোমায়। শুধু তারা দুজন পালিয়ে এসেছিল বাঙলা মুলুকে। সেই শোকের ভার সইতে পারেন নি বৃদ্ধ আবিদেব বাবা। দেড় বছর পাই একমাত্র ছেলে আবিদের হাতে কয়েকলাখ টাকা আর বিরাট ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে মারা নি তিনি। তারপর সাত বছর কেটে গেছে। দিনরাত অমানুষিক খেটে সেই ব্যবসা দিনে দিনে বাড়িয়েছে আবিদ। একদিনের জন্য বিশ্রাম নেয় নি। দেশের এ মাথা ও মাথা চষে বেড়িয়েছে সে কারবারের জন্যে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মজুবদের তদারক করেছে। বন্দরে গেছে। কোম্পানির প্রায় প্রৌঢ় ম্যানেজার আশরাফ মাঝে মাঝেই অনুরোধ করেছে, এমনি করে আর কতদিন, এবারে তার সংসারি হওয়া দরকার। সে কথায় সে কান দেয় নি। হেসে উড়িয়েছে। তারপর বছর দুএক বাদে আশরাফ গোঁ ধরে বসেছে, এবার তাকে বিয়ে করতেই হবে। সে নিজে সব ঠিক করবে, তার কিছু ভাবতে হবে না।