না, এ তার আত্মসংযম–ফারুক ভাবলো। আর এমনি হাজারো ভাবনার ভেতরে একটা অনুভূতিই স্থির হয়ে রইল ব্যথাবিদ্ধ তারার মত, সে আজ থেকে একেলা। কোথাও যাবার নেই। করবার নেই। কথা বলবার কেউ নেই। সে নিঃসঙ্গ।
তারপর যখন দুপুর হলো শিরীষ ডালের ওপর, তখন ফারুক ঠিক করল তাহমিনার সাথে সে দেখা করবে। জিজ্ঞেস করব সঃ কিছু। চুপ করে সে থাকবে না।
একটু পরেই বেরুলো সে। মা বললেন, কিরে বেরুচ্ছিস বুঝি?
হ্যাঁ, তুমিই তো তখন বলছিলে, তাই।
মা হাসলেন। ফারুক বেরিয়ে এলো।
তোপখানা রোডে প্রেসক্লাব পেছনে রেখে তার রিকশা মোড় নিল, সেই ছোট্ট বেগুনি ফুলের বিরাট গাছটার পাশ দিয়ে। পাসপোর্ট অফিস পেরিয়ে সারকিট হাউসের কাছে এলো রিকশা। আর কিছুক্ষণ গেলে পরেই পৌঁছুবে সে তাহমিনাদের একতলার সামনে। এই মুহূর্তে হঠাৎ এক বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা কিংবা হয়ত শংকা তাকে ভর করল।
ছেড়ে দিল বিকশা। তারপর আবার উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল সে।
.
সেদিন দুপুরেই অপ্রত্যাশিতভাবে তাহমিনার সাথে মুখোমুখি হয়ে গেল ফারুক ইউকালিপটাস এভেন্যুর ওপর। ফারুক হাঁটতে হাঁটতে উদ্দেশ্যহীন এসে পড়েছে এখানে। আর তাকে দূর থেকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছে তাহমিনা! ভার্সিটি থেকে ফিরছিল। কোলের ওপর বই আর খাতা—-লাল মলাট দেয়া। পরনে সাদা সিফনের শাড়ি। পিঙ্কের ওপর বৃটি ভোলা কনুই অবধি চোলি। পায়ে কর্ক টম স্যাণ্ডেল। মুখে তার ক্লান্তির ছায়া। অলস এলানো বেণি। চোখে সেই দীপ্তি দেখতে পেল না ফারুক।
কিছুক্ষণ তারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল নীরবে। দ্রুত শ্বাসের তালে দুলে উঠল বুঝি তাহমিনার উন্নত বুক। সে পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত নিচু আর কম্পিত গলায় শুধালো, কবে এলে?
ফারুক কিছুই বলল না। যেন একটি মুহূর্তে অতিবাহিত হলো পৃথিবীর অনন্ত উত্থান ও পতনের সংকেত। শেষ অবধি বলল, কয়েকদিন।
আমাকে খবর দিলে না কেন?
সব কি সত্যি তাহমিনা?
তাহমিনা বুঝি মাথা দোলাতে চাইল কী বলতে গিয়ে। থামল। তারপর বলল, এস কোথাও বসিগে। বলছি।
চুপচাপ পাশাপাশি দুজনে হেঁটে উঠে এলো রমনা রাদেবুতে। একটা কেবিন বেছে নিয়ে বসল। ফারুক শুধালো, কি বলব?
যা খুশি। আমি কিছু খাবো না।
কেন?
আচ্ছা বলো। সামান্য কিছু।
ফারুক অর্ডার দিল পটেটো চিপস আর লেমন ড্রিঙ্ক।
চিপস এলো। কিন্তু একটাও ছুঁলো না কেউ। তাহমিনার আনত চোখের দিকে তাকিয়ে রইল ফারুক। তারপর হঠাৎ ছেলেমানুষের মত বলে উঠল, আমার কথা একবার ভাবলে না মিনু? আমি কি করব, ভেবে দেখলে না? উত্তরের প্রতীক্ষায় সে চুপ করল। কিন্তু তাহমিনা কিছুই বলতে পারল না। ফারুক নিজের হাত টেনে নিয়ে গলা খাদে নামিয়ে বলল, তুমি আমার দিকে তাকাও তাহমিনা। জানি, তুমি তাকাতে পারবে না।
তাহমিনা এবার চোখ তুলল। তাকাল তার পরিপূর্ণ স্বচ্ছ দৃষ্টি মেলে। বলল, সব সত্যি ফারুক। কিন্তু আমি কী করব? আমাকে দুঃখ দিও না।
তুমি কিছুই করতে পারতে না?
কী করতে পারতাম?
তাহমিনা!
আমার কোন উপায় ছিল না
ছিল, তুমি সব করতে পারতে।
তাহমিনা চোখ নিচু করল। পেন খুলে খাতার ওপর হিজিবিজি কাটল খানিক। তাকিয়ে রইল সেদিকে। তারপর উচ্চারণ করল, দোষ আমাকে দিতে চাও, দাও। আমি মাথা পেতে নেব। কিন্তু আমাকে তুমি বোকো না ফারুক। উপেক্ষা করতে চাও, কোরো। ভুলে যেতে চাও, যেও। কিন্তু আমাকে তুমি ঘৃণা কোরো না।
বেশ, করবো না।
আমি কী করতে পারতাম বলো? বাবা ভারী দুঃখ পেতেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি কোন কথা বলতে পারি নি। বাবাকে আমি অসুখী করব কি করে? আমি কী করব? এ আমার হয়ত আত্মহত্যা, তুমি বুঝতে পারবে না ফারুক।
এইখানে আর বলতে পারল না সে। ঝুপ করে টেবিলে রাখা দুহাতের ভেতর মুখ নামিয়ে নিল। কান্নার মুদ্রায় কেঁপে উঠল তার পিঠ, কাঁধ। ফারুক বাঁ হাতের তেলোয় ন্যস্ত করল তার কপালের ভার। একটু পরে বলল, মিনু মুখ তোলো। সকলে কী ভাববে? ওঠ।
মুখ তুলল তাহমিনা। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুছে নিল এক ফোঁটা অশ্রু। সরিয়ে দিল কপালের ওপর পড়ে থাকা একগুচ্ছ চুল। চিবুকের ভাঁজ একবার কেঁপে উঠল। গালে তার ছোট্ট টোল উঠেই মিলিয়ে গেল।
সামান্য কিছু চিপস মুখে দিয়ে সরিয়ে রাখল চিপসের রেকাবি। ফারুক টেনে নিল লেমনের গ্লাশ। দীর্ঘ ফিনফিনে কাঁচের গ্লাশে স্বচ্ছ সবুজ ড্রিঙ্ক। ছোট ছোট বুদবুদ উঠছে। ভেতরে কাঁচের গায়ে লেগে রয়েছে। দুএকটা এখুনি মিলিয়ে গেল। আর কী অদ্ভুত স্বচ্ছতা। মসলিন জমিনের মত। ফারুক হাত রাখল গ্লাশের পিঠে। আর সেই পানীয়ের শীতলতা মুহূর্তে প্রবাহিত হয়ে গেল তার স্নায়ুর গতীরে। সে অসম্ভব জোর দিয়ে গ্লাশটা আঁকড়ে ধরে বলল, অদ্ভুত শিশুকণ্ঠে, আমি তোমাকে বিয়ে করব তাহমিনা।
সে আর হয় না ফারুক।
কেন হয় না?
ওকথা শোনাও আমার পাপ এখন। তুমি বোল না।
তুমি বলতে পারলে মিনু! কিন্তু আমি যে কোনদিনই তা ভাবতে পারব না। আমি তোমাকে—-
তোমার পায়ে পড়ি ফারুক।
ফারুক গ্লাশ থেকে হাতটা সরিয়ে নিল।
তাহমিনা ভাবল, আমাকে তুমি ভুলে যেও ফারুক। আমাকে তুমি, তোমার ঈশ্বরের মত জড়িয়ে ধরে রাখতে চেয়ো না। আমি জানি তুমি কষ্ট পাবে। কিন্তু আমি কী করব? আমি কী করতে পারতাম ফারুক? বিশ্বাস করবে যা তুমি, আমি কত অসহায়, কত রিক্ত! যদি আমাকে ঘৃণা করেও তোমার মুখ বালিশে মিগ্ন থাকতে পারে তবু ভালো, কিন্তু আমাকে বাসনা করে যেন বিন্দ্ৰি না থাকো। তাহমিনা মুখে শুধু বলল, তুমি রাগ করেছ ফারুক।