আমি তোমাকে ভালবাসি তাহমিনা।
আর সে কথা বলল না। কিছুই বলল না। শুধু তার বুকের ভেতরে যেন ছড়িয়ে পড়ল মিঠে ব্যথার মত একটা অনুভূতি। ফারুক চুপ করে থেকে তাহমিনার নীরবতাকে অনুভব করতে চাইল। অনেকক্ষণ পর মুখ ফিরিয়ে বলল, জানো তাহমিনা, আজ আমার অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কেন যেন মেলা বকতে ভালো লাগছে।
তুমি বলো ফারুক! আমি কোনদিন তো না করিনি।
দেড় বছর কেটেছে আমাদের স্বপ্নের মত। কিন্তু জানো কথাও একদিন ফুরিয়ে যায়। বলবার শোনবার কিছুই আর বাকি থাকে না। তখন মুখোমুখি শুধু। আর কী জানো এমন একটা দাবি গড়ে ওঠে, আরো কাছে তাকে পাবার জন্য। তোমাকে আমি আরো ঘনিষ্ঠ করে একান্তভাবে চাই তাহমিনা। আর কতদিন কাটবে?
কী জানি!
কিন্তু তুমি আমার হও তাহমিনা। তোমাকে আমি পরিপূর্ণ করে পেতে চাই মিনু।
এই প্রথম তাকে ও ডাকল মিনু বলে।
দূরে বাঁশের বেড়া দেয়া ছোট ছোট রেস্তোরাঁয় বাজছে গ্রামোফোন। মিহি আবছা সুর আসছে ভেসে। দুপুরে আকাশ ছিল সিলভার গ্রীন। একটু আগেই কোমল ভায়োলেট। আর এখন সেখানে প্রুসিয়ান ব্লু। দুএকটা সোনালি ৩রার ডট। ফারুক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো তার পাশে। অনুভব করতে চাইল তার দেহের উত্তাপ। নান্নিধ্য। অনেকদূরে ইঞ্জিনের বাজল সিটি। নারায়ণগঞ্জ থেকে বুঝি ছটা চল্লিশের লোকাল আসছে। তাহমিনা আবছা গলায় উচ্চারণ করল, আমি বড় নিঃসঙ্গ ফারুক। তুমি আমাকে একেলা থাকতে দিও না।
আরো অনেকক্ষণ তারা বসে রইল সেই অন্ধকারে সবুজ ঘাসের ভিতরে। একসময়ে উঠে এলো দুজনে। কলোনির ভিতরে সোজা র্জিন পথের পাশ দিয়ে আমিনবাগের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তাহমিনা বলল, এত একেলা নিজেকে আর কোনদিন মনে হয়নি। আজ সারা দুপুর আমার কেটেছে কী নিঃসঙ্গতায়।
আমার ও মিনু। বিকেলে তোমার সাথে দেখা হবে, তবু মনে মনে উনুন এসে ভর করছিল আমার।
আমার এই নিঃসঙ্গতা তুমি মুছে দিও!
আমি তোমাকে পরিপূর্ণভাবে পেতে চাই তাহমিনা। আমাকে বড় হতে হবে। তোমাকে পেয়ে আমি বড় হবো।
তাহমিনা তার উত্তরে বলল, তুমি এমনিই বড়। তোমাকে আমি বড় করব সে সাধ্য আমার নেই। সে ভার আমাকে তুমি দিও না।
কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ হাঁটল তারা। উঠলো রাস্তায়। হুহু করে বাতাস বইছে। বাতাসে কপালের কাছে চূর্ণচুল উড়ছে তাহমিনার। বাঁ হাতে আনমনা সে সরিয়ে দিল। ফারুক বলল, শেষ পরীক্ষা তো হয়ে গেল। এবার জীবনের মুখোমুখি এসে দাঁড়াতে হবে। তুমি পাশে এসে না দাঁড়ালে, আমি জানি, হেরে যাব।
দূর, কী যে বলো।
হঠাৎ ফারুক বলল, সুর বদলিয়ে, এক কাজ করি কী বলে?
কী?
খালাআম্মাকে বলি।
কী বলবে?
তাহমিনা গতি শ্লথ করে তাকে শুধালো আয়ত চোখ দীর্ঘতর করে।
বাঃ, কী বলব জানো না বুঝি?
বলতে পারবে?
কেন পারব না? তুমি বললেই পারব। বলো না তুমি।
তাহমিনা সলাজ হেসে বলল, যাঃ ফাজিল কোথাকার! আমার লজ্জা করবে না বুঝি? তুমি যে কী।
ফারুক একথার উত্তরে তাহমিনার হাত তুলে নিল তার মুঠোয়। হাসল। প্রথমে আস্তে। তারপর একটু জোরে। আর তার মুঠোর ভিতরে জড়িয়ে রইল তাহমিনার দীর্ঘ আঙুলের উষ্ণ কোমলতা।
০৬. এর প্রায় ছমাস পরের কথা
এর প্রায় ছমাস পরের কথা। দীর্ঘদিন জ্বরে ভুগে স্বাস্থ্যের জন্য ফারুক গিয়েছিল কক্সবাজারে মাসখানেকের জন্যে। সেখান থেকে ফিরে এসে কথাটা শুনল। কিছুই সে জানে না। তাহমিনাও তাকে জানায়নি। তাহমিনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে সুন্দরবনের টিম্বার মার্চেন্ট আবিদ চৌধুরীর সাথে। আসছে মাসের পনেরো তারিখেই বিয়ে।
প্রথম যখন কথাটা শুনলো ফারুক, তখন কিছুই মনে হয় নি তার। কিছুই ভাবতে পারেনি। অবিশ্বাসও করেনি। যেন কথাটা তার জানাই ছিল। যেন সে সব কিছুই জানতো। কিন্তু সেদিন রাত্রে সে পরিষ্কার করে পাতা নিখুঁত বালিশ সাজানো বিছানায় গিয়ে শুতে শুতে অনুভব করল, হঠাৎ কোথায় যেন কী ভুল হয়ে গেছে। স্থির একপাশে মুখ ফিরিয়ে সে ভাবল। সে কিছুই ভাবতে পারল না। তাহমিনা কেন তাকে কিছুই লিখল না? এই কথা বারবার তার বুকের ভেতরে অশান্ত হয়ে রইল। একটা দম আটকানো শক্ত কিছু যেন গড়ে উঠলো ভেতরে, ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। সে চুপচাপ পড়ে রইল বিছানায়, অন্ধকারে।
দুদিন বেরুলো না কোথাও। যেন তার সব কাজ ফুরিয়ে গেছে, আর কিছুই করবার নেই।
বারান্দায় মিষ্টি রোদে ইজিচেয়ার টেনে বসে রইল সামনের দিকে তাকিয়ে। মা এসে একবার বললেন, কিরে এখনো ভালো লাগছে না তোর?
কই নাতো। ভালো হয়ে গেছি আমি।
ফারুক হেসে উত্তর করল মার দিকে তাকিয়ে।
তাহলে বেরোস না যে কোথাও?
কোথায় আর যাবো মা? পাশ করেছি। কাজের জন্য দরখাস্ত করেছি। উত্তর না এলে আর নড়ব কোথায়?
তোর যত সব সৃষ্টিছাড়া কথা। কেন দুদণ্ড বাইরে বেরুলে ক্ষতিটা কী? এমন করে বসে থাকলে শরীরটা যে ভেঙে ফেলবি বাবা।
মাত্তর দুদিন তো এসেছি। এই মধ্যেই কী বেরুবো? যেতে দাও আর কটা দিন, তারপর। মা ক্ষুণ্ণ হয়ে চলে যান। ফারুক তার দিকে তাকিয়ে থাকে। পায়ের কাছে এখনো শূন্য চায়ের কাপ পড়ে রয়েছে। বিনষ্ট। রোদে দেখাচ্ছে উজ্জ্বল। কিন্তু দূরে পাচিলের ওধারে শিরীষের ডালে বাতাসের অগুনতি খুশি। না সে আর দেখা করবে না তাহমিনার সাথে। ভুলে যাবে তাকে। তাহমিনা যদি তার জীবনে না আসতো কোনদিন, তাহলে সে কী করতো? ও ভাববে এখন থেকে তাহমিনা বলে কাউকে সে কোনদিন চিনত না। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো আত্মপ্রবঞ্চনা করছে সে।