ভারী নিরিবিলি। আরো বলব? আশ্চর্য গোছানো। থাকতে ইচ্ছে করে। শেষের কথাগুলো বলল নিচু গলায়।
তাহমিনা একটু এগিয়ে এলো, তাই নাকি? আমার কিন্তু মোটেই পছন্দ হয় না।
কেন?
তাহমিনা দূরে চৌকির বাজু ধরে বসে বলল, ইতস্তত কপট সুরে, যা নিরিবিলি। একটু যদি পড়তে পারা যায় মন দিয়ে।
অবাক করলেন। ফার্স্ট ইয়ারে এসেই পড়াশোনা?
কেন না? ইংরেজি অনার্স কি খুব সোজা নাকি?
মোটেই না, মোটেই না।
ফারুক মাথা দোলালো হাসতে হাসতে। তারপর বলল, যাই বলুন, আমি নিজে থার্ড ইয়ারে উঠেও কিন্তু পড়ায় মন দিতে পারছি না। কেমন যেন হতেই চায় না।
তাহমিনা একটু উদ্বেগভরা স্বরে বলল, পাশ করবেন কী করে? মানে, ফার্স্টক্লাশ নিতে হবে তো?
দরকার নেই আমার।
ঠিক এই সময়ে ঘরে ঢুকলেন মালেকাবাণু। শুধালেন, কি দরকার নেই ফারুক?
পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস, খালাআম্মা।
কেন?
মালেকাবাণু এসে আবার বসলেন ফারুকের সাথে কথা বলতে। আর তাহমিনা প্রায় সারাক্ষণ চুপ করেই রইল বসে। সন্ধ্যা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের রাস্তা। বিদ্যুতের আলোয় উজ্জ্বল হয় উঠেছে। পথের পীচ দেখাচ্ছে কেমন নীলাভ। কেউ কেউ হাঁটছে। একটা দামি মোটর বেরিয়ে গেল। চারদিকের বাতাসে কোন মিষ্টি ফুলের গন্ধ।
আরো কিছুক্ষণ পরে ফারুক উঠল। মালেকাবাণু আবার একদিন আসতে বলে দোর অবধি এগিয়ে এলেন। আর গেট অবধি এগিয়ে দিতে এলো তাহমিনা একেলা। গেটের এ পাশে। দাঁড়িয়ে সে বলল, এসে কিন্তু মার সাথেই শুধু গল্প করে গেলেন। ভারী স্বার্থপর আপনি। তাই নাকি! জানা ছিল না আমার।
এক মুহূর্ত দুজনে চুপ। ছোট্ট লিলি বাইরে থেকে গেটের কাছে এসে দাঁড়াল। একবার তাকাল দুজনার দিকে। তাহমিনা শুধালো, কোথায় গিছলি রে? সারা বিকেল পাত্তাই নেই।
অইতো, রানুদের বাসায়। জানো রানুরা আজ
থাক এখন। পড়তে যা! লিলি বুঝি উৎসাহে বাধা পেয়ে ক্ষুণ্ণ হলো। বলল, বারে যাচ্ছি তো।
লিলি চলে গেল মুখ ভার করে। ফারুক হেসে বলল, মিছেমিছি মন খারাপ করে দিলেন বেচারির।
যা দুষ্টু। আপনার কিন্তু অনেক সময় নষ্ট হলো আজ।
দূর। চলি তাহলে।
আচ্ছা।
তাহমিনা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে উঠে এলো বারান্দায়। জাকি সেখানে বেতের চেয়ার টেনে দেয়াল–আলোর নিচে ইংরেজি পত্রিকা ওলটাচ্ছিল। চোখ তুলে বলল, চলে গেল নাকি?
হু।
মালেকাবাণু ঘরে উঠে আসছিলেন। তাহমিনা তাকে বলল, আচ্ছা মা, দাদা কী রকম লোক বলোত?
কেন কি হয়েছে এরি মধ্যে আবার?
তখন যে ওসব বলল, যদি শুনে থাকে, তাহলে কী ভাববে? কাল ভার্সিটিতে মুখ দেখাতে পারব?
কি বলেছে শুনি?
কি আবার বলবে? তোমার ছেলের কাছ থেকে শোনো।
তাহমিনা গটগট করে তার নিবে কামরার দিকে চলে গেল। জাকি আবার চোখ ফিরিয়ে নিল কাগজের ওপরে। মালেকাবাণু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। বুঝতে পারলেন না কি ব্যাপার? আর তাহমিনাই বা এতক্ষণ খুশি থেকে হঠাৎ ছুতনো কথায় মুখভার করে চলে গেল কেন? কিন্তু পরমুহূর্তেই অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। যেন কী একটা হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
০৪. ফারুক হঠাৎ জেগে উঠল
ফারুক হঠাৎ জেগে উঠল ইয়াসিনের কণ্ঠস্বরে! ইয়াসিন তাকে কয়েকবার ডাকল, হুজুর, হুজুর, ঘুম গেলেন নাকি?
কিছুটা সময় লাগল তার সেই ঘোর ভাঙতে। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল, আচ্ছন্ন হয়েছিল। এখন চোখ মেলে তাকাল। ছইয়ের ভেতরটা কী অন্ধকার। পাশ ফিরে তাকাল বাইরে। সেই। যে তারাগুলো দুলছিল এখন তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। তার বদলে অনেক নিচে দিগন্তের কিছু ওপরে একটা বিরাট নিঃসঙ্গ তারা ধ্বক ধ্বক করছে। অত্যন্ত সূক্ষ্ম তার একটা রেখা। এসে বুঝি পড়েছে নদীর জলে, নৌকোর কিনার অবধি। আর ফারুক যেন কিছুই শোনেনি। ভাবতে লাগল অতীতের কথা। ইয়াসিন আবার একবার ডাকল। ফারুক এবার বলল, না, ইয়াসিন ঘুমোই নি। ভাবছিলাম। আচ্ছা আর কতক্ষণ লাগবে তোমার পৌঁছুতে?
বেশি না হুজুর। আর ঘণ্টা খানেক।
ও।
আপনি ঘুম যান। নৌকো একেবারে সায়েবের বাংলোর কাছে গিয়ে লাগবে। আপনাকে ডেকে দেব।
আচ্ছা। তুমি বাও।
ফারুক আবার শরীর শিথিল করে এলিয়ে দিল। কেমন ভার হয়ে এলো তার চোখ। স্রোতের টানে বয়ে যাচ্ছে নৌকা। আর এক বিচিত্র শিরশিব অনুভূতি সে স্পষ্ট অনুভব করতে লাগল শিরায় শিরায়। কেমন ঝিমঝিম একটা সুর তরংগের মত। রাতের এই প্রহর পেরিয়ে নদীর দুই পাড় ছাপিয়ে তীরের দীর্ঘ একেকটা গাছের সারের ভেতর দিয়ে সেই সুর যেন অনন্তকাল প্রবাহিত হয়ে গেল।
ইয়াসিন দাঁড় টানছে আস্তে আস্তে। অল্প শব্দ উঠছে। এবার গুনগুন করে গান ধরল—- “ও আমার গুরুর কথা বলবো কী,
আমার ভরিয়া গেছে দুই আঁখি।”
সেই গুনগুন এসে কোমল মূচ্ছনা তুলল ফারুকের ভেতরে। সে তন্ময় হয়ে গেল। ইয়াসিন এবার আরো স্পষ্ট করে গেয়ে উঠল,
“ও বোয় যেমন স্বপ্ন দেখে
মনের আগুন মনে রাখে
আমারও ভিতরে তেমনি–”
ক্রমে উদাত্ত হয়ে এলে তার কণ্ঠস্বর। ভারী হয়ে নামলো ফারুকের বুকের ভিতরে। সে নিঃসাড় পড়ে রইল। ডুবে গেল ক্রমে ক্রমে। ইয়াসিনের গলা যেন অনেক অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। একসময় বুঝি আর সে শুনতে পাবে না। ধীরে ধীরে চোখের পাতা ভার হয়ে এল তার।
০৫. সামনের বাগানে ছোট ছোট
সামনের বাগানে ছোট ছোট নিচু টেবিলের পাশে রাখা চারটে করে হালকা চেয়ার। বাইরের বারান্দায় ডান দিকে বিছানো দামি কার্পেটের ওপর ধবধবে রেশমের চাদর। আর বসবার ঘরটাও আজ নতুন করে সাজানো হয়েছে। লিলির আজ দশম জন্মতিথি। তাহমিনা আর মালেকাবাণু নিজ হাতে সাজিয়েছেন সব। ফুলদানিতে বিরাট তোড়া বেঁধেছে তাহমিনা মধুমল্লিকা আর গোলাপের। জানালা দরজার পর্দাগুলো বদলে দিয়েছে। কামাল সাহেব সময় পান না মোটে। এদিকে চোখ দেবার মত অবসর তার নেই। তবু আজ বিকেলে কোথাও বেরুবেন না তিনি। বিকেলেই পাটি হবে। মালেকাবাণুই ঘুরে ঘুরে সব ব্যবস্থা করছেন। আর এই সময় কাজে লাগছে লাবলুকে। মরিস নিয়ে হৈচৈ করে সব আনতে কুড়োতে ঠিকঠাক করতে লেগে গেছে সে।