অবিশ্যি জানিনে বলবার মত দাবি আমার এখনো আছে কিনা, তাই প্রথমেই জিগ্যেস করে নিলুম।
আবিদ কী কথা বলতে চায় যে যার জন্যে এত ভূমিকার প্রয়োজন? প্রথমে যে দুর্বলতা তাকে ভর করেছিল, এখন আর তা নেই। মনে মনে কঠিন হলো সে। বিন্দুমাত্র সহানুভূতি জাগল তার মনে। অথবা জাগলেও তা এত ক্ষীণ যে সে বুঝতে পারল না। তার চোখে ফুটে উঠল চাপা উপেক্ষার বিদ্যুৎ।
এমন করে আর কদ্দিন তাহমিনা? নিজের বৌ চলে গেলে লোকে কত কথা বলে, সেটা ভাবলে না? এমন করে তুমিই বা কী করে থাকবে? সমাজের স্বীকৃতি ছাড়া? আমি তোমাকে কোনদিন কি ভালোবাসিনি? তোমাকে আমি আজো ভালোবাসি। দেড় বছর ধরে শুধু ভেবেছি, শেষ অবধি দেখেছি তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। তুমি চল।
আর ফিরবার পথ নেই আমার।
নেই?
না। আর সমাজের কথা বলছ? ইচ্ছে হলে আইনে যেমন করে হয় ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার ব্যবস্থা করলেই খুশি হব।
সেতো দেড় বছর আগেই হয়ে গেছে। আইন আর এদ্দিনে আমি তুলবো না। তাছাড়া মনের একটা নিজস্ব আইন আছে। তাকে সম্মান করতে জানি।
তাহমিনার মনে হলো একটা সম্পূর্ণ নতুন মানুষের সঙ্গে সে কথা বলছে যেন। এমনকি কথা বলবার ভঙ্গি কত বদলে গেছে আবিদের। সে উৎকর্ণ হয়ে শুনলো তার সংলাপ। আর কী আশ্চর্য, এমন কী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, এই বাচন ভঙ্গির পরিবর্তন তার মনে এক শিশু কৌতূহলের জন্ম দিল। সে ভালো করে তা বুঝতে পারল না, যেন এই কৌতূহলের একটা নিজস্ব সত্তা আছে, আপনা আপনি একটি সুন্দরের মত তা গড়ে উঠল।
তাহমিনা প্রশ্ন করল, তাহলে কেন তুমি এলে?
তোমাকে নিয়ে যেতে।
আমি এখন মা, আর তা হয় না। যদি আমাকে কোনদিন ভালোবেসে থাকো তাহলে বাবুর জন্যে তুমি পাকাপাকি বিচ্ছেদের ব্যবস্থা কোরো। তুমি এসেছ, না হলে হয়ত নিজেই লিখতুম তোমাকে।
লিখতে? আমাকে?
হ্যাঁ। বাবুর ভবিষ্যৎ আমি ভাববো না?
আবিদ কোনো কথা বলল না। সে জানল, তাহমিনার সন্তান আজ তার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহমিনা কোন দিন এমন করে বলতে পারে তা সে ভাবতেও পারেনি। দুরাশা ছিল, হয়ত মুখোমুখি দাঁড়ালে সে আর না করতে পারবে না, ফিরে আসবে। সে কথা আফিয়াও বলেছিল, দেখো তুমি নিজে গেলে, ও কিছুতেই না এসে পারবে না। হাজার হোক তুমি ওর স্বামী তো।
উত্তরে সে বলেছিল, কিন্তু যদি সে না আসে, তাহলে আমি ছোট হয়ে যাব যে ভাবী। এখন তবু প্রায় ভুলে গেছি, আর কিছুদিন পরে হয়ত মনেই থাকবে না, সেই ভালো। মাঝখান থেকে চোখে দেখে ক্ষতটাকে বাড়াতে চাইনে ভাবী।
আফিয়া মনোযোগ দিয়ে শুনে তারপর বলেছে, এ তোমার মিছে ভাবনা। ও আসবেই, না এসে পারে না।
না, না।
আফিয়া এবার অভিমান করে স্নেহের রাগে গলা ভিজিয়ে বলেছে, আমি তোমার সংসার কদ্দিন দেখব? আমি মরে গেলে?
মরবার বয়স আপনার হয়নি।
তবুও তো। তোমার নিজের লোক থাকতে তুমি এমন করে কষ্ট করবে কেন?
আবিদ উত্তর করেছে, কষ্ট আমার কিছু নেই, বেশ আছি। আর আপনি যেতে চাইলে আমি ছাড়ব কেন?
না, না, তুমি ঢাকায় যাও। তুমি ওর সাথে দেখা করো।
আবিদও কিছুদিন হলো কথাটা ভাবছিল। নতুন করে অনুভব করেছিল তাহমিনার অনুপস্থিতি আর বুকের শূন্যতা। তীব্রতর হয়ে উঠেছিল তাকে কাছে পাবার বাসনা। প্রতিটি মুহূর্ত, তাহমিনা নেই এই কথা গুমরে মরেছে তার ভিতরে। নিজেকে মনে হয়েছে আরো অসহায়। প্রথম সেই আঘাতের পর জোর করে কিছু দিন তাকে ভুলে ছিল, কিন্তু শেষ অবধি তা পারে নি। আফিয়া যতক্ষণ কাছে কাছে থাকে, ততক্ষণ কিছুই মনে হয় না তার। কিন্তু সে একটু দূরে সরে গেলেই তার একাকীত্ব সে অনুভব করতে পারত ভয়াবহভাবে। সে জানে তাহমিনা কেন চলে গেছে, কি সে পায়নি; তবু অভিমান হতো সে কেন চলে গেল বলে। সে কি থাকতে পারত না? তার নিষ্ফল নির্বীজ জীবনে যে সামান্য শেষ ভালোবাসাটুকু ছিল সম্বল, তাকে সে উপড়ে দিয়ে গেল কেন? শুধু তাকে, সে ভালোবাসতে পারত না? সমস্ত অভিযোগ সব অভিমান দলা পাকিয়ে বুকের ভেতরে ভারী হয়ে কণ্ঠনালী রুদ্ধ করে দিতে চাইত।
সবাই যখন শুয়ে পড়ে, তখন শোবার ঘরে আবিদের ঘুম আসে না কিছুতেই। বিরাট খাটের শূন্যতার ওপর এপাশ ওপাশ করে শুধু ও। আনমনে, কিংবা দুরাশায় চোখ বুজে পাশে হাত বুলোয়, হয়ত তাহমিনার দেহগর্শ ঠেকবে এই ভেবে। কখনো কখনো শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। খালি পায়ে পায়চারি করে কার্পেটের ওপরে। নিরর্থক তাকিয়ে থাকে ছোট করে রাখা বেডল্যাম্পের দিকে। তারপর জানালার কাছে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে চোখ মেলে দেয়। সহসা মুখ ফিরিয়ে বলে তুমি কেন গেলে তাহমিনা?
যেন তাহমিনা এ কামরাতেই আছে শুনতে পাবে।
দিনে দিনে তাহমিনার অভাব তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল তার কাছে। সে বুঝেছিল, তাহমিনাকে ছাড়া তার বেঁচে থাকা নিরর্থক। তার ভালোবাসা তার কাম্য। সে তাহমিনাকে ফিরিয়ে আনবেই।
ঢাকায় এসে জাকিদের বাসায় ওঠেনি। হোটেলে গেছে। মালেকাবাণুর সাথে দেখাও করে নি। দুপুরে গেছে জাকির আপিসে। বাইরে সেই মরিস দাঁড়িয়ে আবিদের মনে পড়েছিল বিয়ের পর সে আর তাহমিনা এই কারে করেই গিছল নারায়ণগঞ্জে। স্টিমারঘাট অবধি। এগিয়ে দিতে এসেছিল সবাই। পাশে ছিল লিলি। জাকি ড্রাইভ করছিল। আর লাবলু তার পাশে। কামাল সাহেব আর মালেকাবাণু বাড়িতেই ছিলেন। আর মনে পড়ল স্টিমারের ডেকে বসে অন্ধকার আকাশে দুজনের তারা দেখার কথা। একটা তারার ভুল নাম বলেছিল সে। তাহমিনা শুধরে দিয়েছে, ওটা কাল-পুরুষ।