আবিদ কিছু একটা বলতে গিয়ে পারল না। একবার মাথা কুঁকালো শুধু অস্পষ্ট ভঙ্গিতে।
তাহমিনার মনে হয়েছিল প্রথমে, এই যে মানুষটা তার চোখের সমুখে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে সে কোনদিনও চিনতো না। দীর্ঘ সেই মানুষটার দেহ কী এক ক্লান্তির ভারে নুয়ে এসেছে যেন ঈষৎ। পরনে ছাই ছাই স্যুট—-তাতে আরো ম্লান আরো বিষণ্ণ দেখাচ্ছে তাকে। আর কী অসম্ভব স্থবির তার উপস্থিতি। বাঁ হাতে শিরা ফুটে উঠেছে দৃঢ়তায় নয়, দৌৰ্ব্বল্যে। হয়ত তাই। একটা রেখার মত, একটা অবাস্তব অথচ অনস্বীকার্য উপস্থিতির মত, পৃথিবীর। আতঙ্কের মত ওই মানুষটার আশ্চর্য উপস্থিতি।
তাহমিনা তেমনি অস্ফুটস্বরে, কেন না এর চেয়ে উঁচু পর্দা তার এখন এলো না, উচ্চারণ করল, এসো।
কিন্তু শোনা গেল না বুঝি তার সেই স্বর। কেননা আবিদ এতটুকু নড়ল না তার অবস্থান বিন্দু থেকে। পরে তাহমিনা এক পা পেছুলো, মুখ করলো তার কামরার দিকে। আর তখন আবিদ উঠে এলো একেকটা সিঁড়ি অনেক সন্তর্পণে মাড়িয়ে, রেলিংয়ে বাম করতাল ছুঁইয়ে চুঁইয়ে। নিঃশব্দে দুজনে গিয়ে ভেতরে বসলো। চৌকাঠে পা রেখেই আবিদের চোখ পড়েছিল দোলনার ওপরে। সে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এক মুহূর্তের জন্যে। প্রথমে কিছুটা বিস্ময়, তারপর একটা চাপা হিংস্রতা যেন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এক ধরনের তীব্র হিংসায়। নীল ধ্বক ধ্বক করল তার চোখ।
আর তাহমিনা হয়ত সে সময়ে আর্ত চিৎকার করে উঠতো। কিন্তু ওঠেনি। সে চাইল বাবুকে তার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখতে। ভীষণ একটা ভয় ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে তার ভিতরে ছড়িয়ে পড়ল। ভাবল, আবিদ কি করবে এর পর? এদ্দিন বাদে কেন সে এলো ঢাকায়? যদি কিছু একটা অনর্থ বাধিয়ে ফেলে আজ, এখুনি! তাহলে কী সে করবে? দেড় বছর ধরে যে সাহস ছিল তার চোখে এখন এক মুহূর্তে তা ভীরু হয়ে গেল। আবিদ যদি কোনদিন তার মুখোমুখি হয়, সে ভেবেছিল, কিছুই সে হতে দেবে না। হার মানবে না। অথচ আজ সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শুধু অসহায় লাগল তার নিজেকে। একটু আগেই সে আবিদের চোখে দেখেছে হিংসার নীল আভা; সে কথা ভেবে পর মুহূর্তেই কঠিন হয়ে এলো তাহমিনা। ঋজু শান্ত ভঙ্গিতে আবিদকে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল একটু দূরে।
আবিদের সহসা ভীষণ তীব্র একটা সাধ হলো বাবুকে দেখবার। তার মনে হলো দোলনার ওপর শুধু ঘুমিয়ে থাকা এক শিশু নয়, তার চেয়ে আরো কিছু বেশি এবং অন্য কিছু সে দেখতে পাবে। তাহমিনার গর্তে যে সন্তানের জন্ম, তার মুখের আদল কেমন, তা সে দেখতে চায়। কিন্তু তাহমিনার সেই ঋজু ভঙ্গি তাকে বিহ্বল করে দিল। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সে বসলো চেয়ারে। তারপর শরীর এলিয়ে দিল অলস ভঙ্গিতে।
সমস্ত কামরায় এখন তীব্র নিস্তব্ধতা। কেউই শুরু করল না প্রথমে কোনো কথা। কিন্তু দুজনেই যেন বুঝতে পারল এ ভারী অশোভন হচ্ছে। তাই দুজনেই চাইল একটা কিছু বলতে। অনেকক্ষণ পরে, প্রথমেই তাহমিনা, কবে এসেছ?
কামরার দূর প্রান্তে দাঁড়িয়ে তাহমিনা। তার স্বর যেন তীরের মত বিদীর্ণ করল সহসা এই স্তব্ধতাকে। আবিদ চোখ তুলে উত্তর করল, কাল। যেন যথেষ্ট বলা হল না, এই ভেবে সে আবার বলল, কাল ভোরে। হোটেলে উঠেছি।
ও।
তাহমিনা উচ্চারণ করল না, একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল। তারপর সেও বসল একটা চেয়ারে আস্তে আস্তে পিঠ ধরে। আবিদেব বসে থাকা ভঙ্গি দেখে সহসা তার মনে হলো যেন লাফ দেবার পূর্ব মুহূর্তে একটা বাধ ওঁৎ পেতে বসে আছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে অন্ধের মত। তাহমিনা বলল, কেন তুমি এলে?
আবিদ এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। একটু পরে ধীরে ধীরে বলল, এমন করে চলে এলে কেন তাহমিনা? আমাকে বললে না, কাউকে বললে না। ফারুকের কথা আমি জানতামও না। আমি হাসপাতালে, শেষবার দেখাও করলে না।
আবিদের প্রত্যেকটা বাক্যের ভেতরে বেশ কিছুটা করে যতি। অনেক বড় কোন কথার যেন মাঝখান থেকে তুলে তুলে সে বলে গেল। তবু তাহমিনা বুঝতে পারল স্পষ্ট, কী সে বলতে চাইছে।
সে শান্ত গলায় বলল, আমার এ ছাড়া কোনো পথ ছিল না।
আবিদ একটুকাল তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর, কিন্তু আমার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছিল। আমি তোমার স্বামী। কথাটা বলে নিজেই যেন চমকে উঠল সে। নতুন কথার মত শোনাল তার নিজেরই সংলাপ। আর এন তাহমিনার দিকে ভালো করে তাকিয়ে সে অনুভব করল, তাহমিনা তার কত দূরে সরে গেছে। তাকে সে আর স্পর্শও করতে পারবে না। এমনি দূর।
তাহমিনার কানে এই আমি তোমার স্বামী বাজলো একটা তীব্র ধাতব সংঘাতের মত। সে চুপ করে রইলো। আবিদ হঠাৎ আঙ্গুল তুলে শুধালো, খোকা?
হ্যাঁ।
কী নাম?
বাবু।
ও কোথায়?
আপিসে।
তাহমিনা অপেক্ষা করছিল, হয়ত আবিদ এখুনি দোলনার কাছে এগিয়ে যাবে। তার মনে হলো হয়ত একতাল মোমের মত দুহাতে তুলে পিষে ফেলবে বাবুকে। একটা তীক্ষ্ণ শংকা তাকে বিদ্ধ করল। কিন্তু আবিদ উঠলো না, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল দ্রুত। তাহমিনা আশ্চর্য রকমে ব্যথিত হলো। সে যদি তা করত, তাহলে কি সত্যি সত্যি সে খুশি হতো? হঠাৎ আবিদ স্বর পালটে নরম গলায় বলল, তাহমিনা, একটা কথা তোমায় বলব?
বলো।
কেন তার কণ্ঠ এমন কোমল হলো? না না। নিজেকে মনে মনে অভিশাপ দিল তাহমিনা।