এটা তোর কাছে রাখবি। কাছছাড়া করবি না আর বাংলোয় আনবি না কখনো, তোর কামরাতেই রেখে দিস।
আবদুল একটু বিস্মিত হয়ে বলেছে, আচ্ছা।
কয়েকদিন পর আবিদ আশরাফকে বলেছে, রাইফেল সব বন্ধ করে চাবি নিয়ে গেছেন, না?
তবে কি আবিদ সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল? আশরাফ চমকে উঠল। বলল, হ্যাঁ।
আবিদ একটু কাল তার দিকে তাকিয়ে তারপর হাতের বই ওলটাতে ওলটাতে বাইরের দিকে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলেছিল, আপনার ভয়, আত্মহত্যা করব। না করব না। এইখানে। একটু হাসল সে, তাহলে অনেক আগেই করতুম। যে মরেছে সে আবার মরে না।
মরে না ঠিকই, আবিদও হয়ত মরতে চায় না, তবুও আশরাফ দেখেছে দিনের পর দিন যে অযত্ন আর বিশৃঙ্খলা চলেছে তাতে মন্দ একটা কিছু হবার আশঙ্কা আছে পুরোপুরি। তাই একদিন আফিয়া আর খোকাকে সে নিয়ে এলো এ বাংলোয়। তারপর থেকেই আবিদের পুরোপুরি ভার আফিয়ার ওপর। ধীরে ধীরে সে ফিরিয়ে আনলো সংসারের শ্রী আর শৃঙ্খলা নিপুণ হাতে। আবিদের নাওয়া খাওয়ার ধরাবাধা সময় হলো। ইচ্ছেমত ডেকচেয়ারে বসে আকাশ পাতাল ভাববার তার আর অবকাশ বইল না। সে সময় আফিয়া কাছে এসে গল্প করতো। তাকে ভুলিয়ে রাখতে চাইতো। বার থেকে দেখলে মনে হতো ঠিক আগের মতই আবার সব কিছু চলছে, শুধু একটু কাছে এলেই আজো অনুভব করা যায় সেই শূন্যতা। আফিয়া মাঝে মাঝে কথা তুলত। কিন্তু আবিদ আর আগের মত উড়িয়ে দিত না ম্লান হেসে, শুধু চুপ করে থাকত। তার এই নীরবতা দেখে একটু আশান্বিত স্বরে আফিয়া হয়ত বলে, তাহলে কবে যাবে বলো? নাকি খোকার আব্বা যাবে?
আমার ভালো লাগছে না ভাবী। আমি কিছু ভাবতে পারছিনে। একটু পরে আবিদ নিজেই শুরু করে, আচ্ছা ভাবী, তোমরা তো মেয়ে ওর কি একবারও আমার কথা মনে পড়ে না?
পড়ে বৈকি? দেখো, তুমি গেলেই আসবে। এদ্দিনে ভুল বুঝতে পেরেছে ও।
না, পড়ে না। আর ভুল বলছ কাকে? তুমি তো সব শুনেছ। না, না, ভুল ও হয়ত করে নি।
আফিয়া ইঙ্গিতটি বুঝতে পারে। নীরব হয়ে যায়। এরপরে তার আর কিছু বলবার থাকে না। আবিদ উদাস সুরে প্রায় নিজেকেই বলে, তুমিও পারলে না। বলো, এরপরেও আসবে? ও যেমন আছে তেমনি থাক, আমি গিয়ে অন্তরায় হবে না। হতে চাই না। আমি এমনিই বেশ আছি।
তোমাকে একটু কফি দিই, না?
দাও।
আফিয়া একটি ছল করে কিছুক্ষণ দূরে সরে থাকতে চায়।
১৭. কাগজের একটা বিশেষ সংখ্যা
কাগজের একটা বিশেষ সংখ্যা বেরুবে। ফারুক তাই কদিন হলো আপিসে অত্যন্ত ব্যস্ত। দুপুরেই চলে যায়, আসে অনেক রাতে। সারা দুপুরটা তাই একেলাই কাটে তাহমিনার। তবু একেলা নয়। অনভিজ্ঞ নতুন মা–র হাজারো ব্যস্ততায় সময় তার গড়িয়ে যায় কখন। মাত্র চার মাস বয়স হয়েছে বাবুর ছেলেকে তারা আদর করে ডাকে বাবু—-তবু তারি দস্যিপনায় তাহমিনা অস্থির। দেখতে হয়েছে ঠিক তার মত। তেমনি গৌর, তেমনি নাকের গড়ন। সব কিছু তাহমিনার মতই। মাঝে মাঝে অপলক চোখে বাবুর দিকে তাকিয়ে এই সাদৃশ্য দেখে তাহমিনা।
আজ দুপুরে বাবু জেগে রয়নি তাকে বিরক্ত করবার জন্যে। কাঁদে নি। মাই খেতে খেতে যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন দোলনায় শুইয়ে দিয়েছে তাকে। তারপর সেই ফাঁকে সেরে নিয়েছে নিজের নাওয়া খাওয়া। দুপুরে যাবার সময় ফারুক আয়নার সামনে শেষবার চিরুনি চালাতে চালাতে চাপা হাসি গলায় ডেকেছে, বাবুর মা, ও বাবুর মা।
বারান্দায় কী একটা কাজ করছিল তাহমিনা। হঠাৎ করে এমন একটা ডাক শুনে তার বুকের ভেতরে রক্ত ছাৎ করে উঠেছে। বলেছে, যাঃ।
আহা, শোনোই না ইদিকে।
ডাকটা নতুন আর কেমন মিষ্টি লেগেছিল তার কাছে। আর একবার শুনতে তার সাধ হলো। এসে বলল, কী বলছ শুনি?
আরো কাছে এসো।
কাছে আসতেই ফারুক একেবারে আড়কোলা করে তুলে বুকের সাথে চেপে ধরেছে।
দিন দুপুরে একি! ছাড়ো, ছাড়ো বলছি।
ফারুকের এই খামকা ব্যবহারে তাহমিনা সত্যি সত্যি একটু বিরক্ত হয়েছিল। কিন্তু সে ছাড়ে নি তবুও। চেপে ধরে গালের ওপর একে দিয়েছে অনেকক্ষণ ধরে চুম্বনচিহ্ন
নাওয়া খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে আয়নার সামনে সে দাঁড়িয়ে দেখল, এখনো সেখানে ফিকে লাল আভা। ছি, ছি, ফারুকটা কী। এমন করে নাকি কেউ? বারান্দায় এসে সারা মুখ রগড়ে ধুয়ে ফেলল আবার। এরচে সারামুখ লাল দেখাক, তাও ভালো। তারপর বুলোলো একটু পাউডার প্রলেপ সেটা ঢাকবার জন্যে। তারপর বাবুর দোলনার পাশে বেতের একটা চেয়ার টেনে বসলো ছোট্ট একটা সেলাই হাতে করে। বাইরে স্নান হলুদ রোদে মন্থর প্লাবিত পথ। দুএকটা বাড়ির ছাদে বাতাসে কাঁপছে শাড়ি। আর কেমন নিস্তব্ধতা। ঠিক স্তব্ধ নয়, তবুও শব্দ নেই যেন কোনোখানে। টেবিল কাকে তিনটের ঘর পেরিয়ে গেল ঘণ্টাব কাঁটা। তাহমিনা এব বার অলস চোখ তুলে সময় দেখলো।
ঝি এসে বলল, আপামণি।
কিরে?
কে একজন ভদ্রলোক বাইরে নিচেয় দাঁড়িয়ে।
কে ভদ্রলোক? কাকে চায়?
জাকি নয়ত? লাবলু নয়ত? কে এলো এখন! ফারুকের কাছে তো কেউ আসে না বড় একটা। আর এমন উদ্বিগ্ন হলো কেন সে খামোকা? ঝি উত্তর করলো, আপনার কথাই বললেন।
আমার কথা? নাম বললেন?
না।
হয়ত নাম শুনে আসবার জন্যে ঝি দরোজার দিকে পা বাড়ালো, এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে কার উঠে আসবার শব্দ শোনা গেল। তাহমিনা উঠে বারান্দায় এসে দেখলো আবিদকে! আবিদ একটা ধাপের ওপর পা রেখে দেখল তাহমিনাকে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল তারা। তাহমিনা অস্ফুট স্বরে বলল, তুমি!