বেশ। যা বলবে আমাকেই বলবে, ফারুককে কিছু বলতে পারবে না। আমার ওপর তোমার অধিকার আছে মনে করেই এসেছ, কিন্তু ওর ওপর যে নেই এটা মনে রাখলে খুশি হব।
বল।
তাহমিনা খাটের পাশে এসে বসলো। তার কথাগুলো শোনাল দৃঢ় আর অনমনীয়। এমনভাবে শুরু করলো যেন এখুনি সে শেষ করে ফেলতে চায় সব কথা। সময় নষ্ট হতে দিতে চায় না। ফারুক সরে গেল সেখান থেকে।
জাকি নরম সুরেই শুরু করল, তুমি যে এমুন করবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
আমিও না।
তাহমিনার উত্তর শুনে চমক ভাঙ্গল জাকির। প্রশ্ন করলো, কেন?
নতুন করে বলবার ইচ্ছে নেই, নইলে বলতাম। মার কাছ থেকেই শুনে নিও।
কিছু হলে আমাকে তোমার বলা উচিত।
তোমরা আমার ভালোর জন্যেই সব করেছিলে। সে ভালো সইলো না। তাই নিজের ভালো নিজেই বেছে নিয়েছি।
আমাদের মুখে চুন কালি দিয়ে?
আমি ছোট্ট আর নই, আমি সব বুঝি।
তবুও?
হ্যাঁ।
জাকি থামল। তারপর সুর চড়িয়ে বলল, আবিদ চুপ করে থাকবে না, তা জানো?
তার যা খুশি করতে পারে।
ও।
কিছু করতে হলে সে-ই করবে। তোমাদের করবার কিছু নেই।
হয়ত নেই; আশরাফের চিঠি পাবার পর অন্তত বোন হিসেবে আমার যা করবার আছে তা করতে চেয়েছি। সেটা কি অনুচিত?
না। আমার যা বলবার সব মাকে বলেছি।
শুনেছি।
তারপর না এলেও তোমার চলত। সেই আমার শেষ কথা। তুমি এখন যাও।
এত শীগগীর যে তাহমিনা যবনিকা টানবে তা জাকি আশা করে নি। নরম সুরে তোক, চড়া সুরে হোক সে একটা বিহিত করতেই এসেছিল। কিন্তু তাহমিনার মুখোমুখি এসে সে যেন। কেমন খেই হারিয়ে ফেলেছিল। তাছাড়া এরপর, সে ভাবল, আর কিছু বলা বৃথা। উঠে দাঁড়াল। বলল, বেশ আজ থেকে মনে করবো আমাদের কোন বোন ছিল না। আমি চললাম।
তাহমিনা কোনো উত্তর করল না। যখন ও দরোজার কাছে গেল, তখন বলল, এরপর বাসায় বোধ হয় আমাকে যেতে দেবে না?
সে তোমার ইচ্ছে।
জাকি সিঁড়ি বেয়ে দুধাপ নামল। পাশে আলো জ্বলছে। জাকিকে একটু বেঁটে দেখাল ওপর থেকে।
মার খবর পাবো না?
তোমার দরকার কি?
আমার মার খবর দেবে না? যেতে দেবে না?
এ মুখ দেখিও না তাকে।
জাকি নেমে গেল। তাহমিনা দাঁড়িয়ে রইল সিঁড়ির ওপরেই। একটু পরে সে শব্দ শুনল বেবি মরিস স্টার্ট নিচ্ছে।
.
একদিন সকালে ফারুক আবিষ্কার করল তাহমিনা কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। আশ্চর্য মন্থরতা তার চলনে। আর চোখ জোড়া আয়ত উজ্জ্বল। ফারুকের দিকে তাকাতে গিয়ে বারবার চোখ নামিয়ে নিল। বলনে কেমন চাপা খুশি, ফারুক লক্ষ্য করল। দুপুরে প্রায় সে ভুলেই গেল কথাটা। আর তার মনে রইল না।
রাতে যখন ফারুক ফিরে এলো তখন তাহমিনা এলিয়ে ছিল বিছানার ওপর। কাপড় বদলাতে বদলাতে ফারুক শুধালো, খেয়েছ?
না।
আজ দেরি যে বড়?
ভালো লাগছে না। তুমি খেয়ে নাও।
ফারুক খাটের কাছে এসে বসে বলল, কী হলো তোমার?
কিছু না।
তবে?
নাগো না, অসুখ করেনি। একদিন কি খারাপ লাগতে নেই? কী যে তোমার বুদ্ধি। যাওতো এখন।
ফারুক খেয়ে এসে শুয়ে পড়ল তার পাশে। তাহমিনা এপাশ ওপাশ করল খানিক। একবার গলায় বাহু জড়িয়ে দিল তার। মুখ লুকালো। পড়ে রইল অনেকক্ষণ, তারপর আবার মুখ। তুলে নিল। ফারুক শুধালো, কিছু বলছ না মিনু।
উ।
আজ তোমাকে– কি হয়েছে তোমার?
তাহমিনা বালিশে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল। ফারুক ওর চিবুকে হাত রেখে তাকাল। আবছা আলোতেও দেখতে পেল তার ঠোঁটে মিহি হাসির রেখা—- অদ্ভুত একটা ভাঁজ। সহসা তার মনে বিদ্যুতের মত নিমেষের জন্য একটা কথা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তার হাত কাঁপল একটু।
তবে কি তাই মিনু?
হুঁ।
কবে টের পেলে? কিছু বলোনি?
আজকেই।
কী করে বুঝলে?
ও তুমি বুঝবে না। তারপর তাহমিনা তাকাল ফারুকের চোখে চোখে অন্ধকার। ফারুক তখন চোখ বুজেছে কিন্তু তা দেখতে পেল না তাহমিনা। সে তাকিয়ে রইল।
১৬. তাহমিনা চলে যাবার পর
তাহমিনা চলে যাবার দেড় বছর পর আবিদ এলো ঢাকায়। এই দীর্ঘ দেড় বছর সে কোথাও বেরোয় নি। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেছে। ব্যবসারও সমস্ত কাজ প্রায় ছেড়ে দিয়েছে আশরাফের হাতে। ভালো মন্দ সে যা করছে তাই ভালো। মাঝে মাঝে জরুরি কাগজপত্রে সই করে ও শুধু। আর মোটা টাকার দরকার হলে চেকে। তার উচ্ছল প্রাণ বন্যায় একটা পাথর চাপা পড়ে রুদ্ধ হয়ে গেছে। নিরানন্দ দিন আর নীরব মুহর্ত। ডেক চেয়ারে বসে থাকাটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে তার • খেতে খেতে কোনদিন মুখে গ্রাস তুলে হয়ত চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। আবদুল অস্বস্তি বোধ করে পাশে দাঁড়িয়ে। তবু হয়ত সে তেমনি চুপ করে ভাবছে। তারপর হঠাৎ চমক ভেঙে দ্রুত খাওয়া শেষ করে ন্যাপকিনে মুখ মুছে উঠে আসে। আবদুলের দেখে শুনে ভালো লাগে না। কোন কোন দিন আশরাফকে সে ক্ষোভের সাথে বলে, হুজুর, এরচে আমাকে বিদেয় দিন, চলে যাই।
কিন্তু তাই বলে সত্যি সত্যি সে চলে যায় না। সব সময় ছায়ার মত আবিদের সাথে সাথে থাকে। অনেক রাতে উঠে আবিদের কামরা দেখে আসে।
আশরাফও ভাবছিল এমন করে আর কদিন? দিনে দিনে আবিদের শরীর ভেঙে পড়ছে। অথচ জিগ্যেস করলে, বললে, কানই দেয় না। স্পষ্ট সে বুঝতে পেরেছিল, এমন করে বেশি দিন চললে একটা কিছু হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া কি নিয়ে ও বেঁচে থাকবে? কি তার অবন? এমন স্তব্ধ পাথর জীবন সে বইবে কী করে? একদিন আশরাফের মনে হয়েছে যদি সে আত্মহত্যা করে। আফিয়াকে সে বলেছিল কথাটা। সেও সায় দিয়েছে, কিছুই বিচিত্র নয়। পরদিন আশরাফ বাংলোয় গিয়ে সব বন্দুক কিওরিও ঘরে রেখে তালা বন্ধ করে চাবি নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। শুধু একটা বন্দুক দিয়েছে আবদুলকে।