কী লিখলে আজকে?
ফারুক প্রত্যুত্তরে সম্পাদকীয়ের শিরোনামটা জানায়। দুএকটা মজার খবরের কথা বলে খেতে খেতে। তাহমিনা শোনে। তারপর হয়ত, আচ্ছা মিনু, ভোর সকালে কাগজ বেরুবার। নিয়ম কে আবিষ্কার করেছিল বলতে পার?
কী জানি।
যেই বের করুক, ভাল করেনি। কী ট্যাজেডি বলোত? শহরে নিশাচর বলতে এক পাহারাওয়ালা আর খবরের কাগজের লোক।
আর চোর বাটপাড়?
তারাও এ দুদলের মধ্যেই পড়ে।
বলেই ফারুক হেসে ওঠে। একটা সিগারেট ধরায় আয়েস করে।
তাহমিনা বলে, এতই যখন তখন খবরের কাগজে কাজ না করলেই পার? অন্য কোথাও দেখ না।
উঁহু। অন্য কাজে পয়সা আছে, তৃপ্তি নেই। তবু তো সারারাত আমায় থাকতে হয় না। তাহলে যে কী করতে!
কিন্তু সবদিন এমন যায় না। কোনোদিন ফারুক ফেরে, একটু অন্যমনা দেখায়। কী যেন ভাবে, কথা বলে না। বললেও ভাল করে বলে না। তার কাছাকাছি সরে এসে খুব কাছে মুখ রেখে তাহমিনা জিগ্যেস করে, কী হয়েছে তোমার?
কই কিছু নাতো।
তাহমিনার বুক কেঁপে ওঠে। সুন্দরবনের দীর্ঘ অরণ্য যেন বুকের ভেতরে মাথা কুটতে থাকে। তবে চুপ করে রয়েছ কেন?
এমনি।
মিছে কথা। ভাবছ তাই না? কী ভাবছ?
ফারুক তার চোখের দিকে চোখ রেখে আস্তে আস্তে বলে, আমি ভাবছি নে মিনু।
কিন্তু ফারুকও জানে, তাহমিনাও জানে, এ মিছে কথা! ফারুকের মনে এখন দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভয়। সে আর তাকাতে পারে না তাহমিনার দিকে। তাহমিনা ওর হাত ধরে স্পর্শ থেকে অনুভব করতে পারে তাব মনের কথা। বলে, তুমি আমাকে ভালোবাসো?
কেন, মিনু?
সত্যি বলো।
এরচেয়ে বেশি কি বলব। তুমি কি জানো না, তোমায় আমি কত ভালোবাসি?
তাহমিনার দুঃখ হয়। খুশি হয় না। ক্ষুণ্ণ হয়। বলে, তাহলে তোমার দ্বিধা কেন?
না, না।
বলে ফারুক দুহাতে ওকে আকর্ষণ করে বুকের উত্তাপে বাধে। তাহমিনা শিথিল স্বরে নিচু পর্দায় উচ্চারণ করে, আমার দিকে তাকাও আমার চোখের দিকে—-আমার জড়িয়ে আসে, কিছুটা অর্থহীন হয়ে আসে তার কথা। কিন্তু বুঝতে পারে ফারুক, কী, ও বলতে চায়। মৃদু গলায় বলে, তুমি আছো, আমি সব ভাবনার ইতি করে দিয়েছি।
তাহমিনা তার সমস্ত শরীর শিথিল করে সাহস সঞ্চারিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে অনেকক্ষণ।
১৫. সেদিন ছিল ছুটি
সেদিন ছিল ছুটি। ফারুককে আপিসে যেতে হবে না। তাহমিনার শুধু সকালের টিউশানি। বিকেলেরটায় ছুটি তারো। দুপুরে তাহমিনা বেরিয়ে গেল একেলা। বলে গেল ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরবে। ফারুক সে সময়টা শুধু শুয়ে ঘুমিয়ে কাটালো।
ফিরে যখন এলো তখন ফারুক জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসে বলল, এলে?
হুঁ। কোথায় গিছলাম বলোত?
তুমি না বললে জানব কী করে, বাহ্।
আমিন বাগে।
তোমার মার কাছে? হঠাৎ কী ব্যাপার?
সব সম্পর্ক চুকিয়ে এলাম।
ফারুক ঘুরে ওর মুখোমুখি হলো। কেন যেন ভয় পেল। কেন যেন তাহমিনাকে সে সমর্থন করতে পারল না মনে মনে।
শাড়ির আঁটসাট ভাঁজ শিথিল করে অলস ভঙ্গিতে খোঁপা আলগা করে দিতে দিতে তাহমিনা ছোট্ট হাই তুলে বলল, তোমাকে বলিনি। মা জানতে পেরেছিলেন সব। ভেবেছিলুম জানাবো না। এখনকার জন্যে নয়, বিয়ের ওপরই দুঃখ হোতো তার। সেটাও আমি চাইনে। লাবলু একদিন এসেছিল সন্ধ্যের পর। মা এক পাও নড়তে পারেন না, নইলে দেখতে নিজেই চলে আসতেন। তাছাড়া বোধ হয় আমাকে ঘেন্নাও করেন, নইলে আসতে কি?
লাবলু কী বলেছে? জাকি?
জাকি ভাই অফিসিয়াল কাজে করাচি গিছলেন, আজকেই ফিরেছেন। এখনো আপিসে। দেখো আজকেই না এসে পড়ে এখানে।
কেন?
দেখো, আসবেই। মাকে সব কথা বলেছি, না বলে উপায় ছিল না। তোমাকে বলিনি, তুমি ব্যস্ত হয়ে পড়বে তাই। কী আশ্চর্য জানো, মা আমাকে অবাক করে দিয়েছেন। একটুও কাঁদলেন না, কিছু না, শুধু চুপ করে রইলেন।
মা আঘাত পেয়েছেন।
কী জানি। আর বাবা, বাবা আমার নাম অবধি শুনতে চাননি। আমি তার কাছে মরে গেছি। দুঃখ শুধু, কেউ বুঝলো না ফারুক। তারপর একটু পর, একটু থেমে তাহমিনা মাথা ঝাঁকিয়ে সেই আবহ কাটিয়ে দিতে দিতে বলল, মা শুধু বললেন, কবে মরে যাই তার ঠিক নেই, আমাকে ফেলে যাবি?
তাহমিনা উত্তরে কী বলেছে ফারুক তা শুধালো না। তাহমিনাও বলল না। চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ তাহমিনা মাথা ঝাঁকিয়ে সেই আবহ কাটিয়ে দিতে দিতে বলল, চল বেরোই। আজ না সিনেমায় যাব।
তাহমিনা অনুমান করেছিল ঠিকই যে জাকি আজকেই আসবে। এলো তাই। তাহমিনা মালেকাবাণুকে বলেছিল, লাবলুও জানতো, তারা কোথায় বাসা করেছে, সেই নিশানা ধরে। কিন্তু পেল না কাউকে। ঝিকে জিগ্যেস করে জানলো সিনেমায় গেছে। মরিস নিয়ে আবার সে বেরিয়ে গেল। ফিরে যখন এলো তখনো ওরা ফেরেনি। ঝি ওপরের ঘর খুলে দিলে পর সে বসে রইল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তাহমিনা বলল, ওপরের ঘরে আলো জ্বলছে। ঝিটার আক্কেল দেখো। বাসায় এক দণ্ড না থাকলে এমনি করতে হয়!
কোন দরকারে হয়ত জ্বেলেছে।
এমনি কথা বলতে বলতে ওরা ওপরে এসে দোরপর্দা সরিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল। তাহমিনা চোখ নিচু করল কিছুটা। ফারুক তাকিয়ে রইল সোজাসুজি। জাকি একটা খাড়া পিঠ চেয়ার টেনে বসে আছে। তাহমিনা ঢুকতে ঢুকতে বলল, জানতুম তুমি আসবে। কিন্তু সব কথা আমি মাকে বলে এসেছি।
জাকি একটুকাল নিঃশ্বাস বন্ধ করে থেকে তারপর বলল, আমার সাথেও তোমার কথা হওয়া দরকার। তাই এসেছি।