তোষকের নিচে পেল চাবি আর একটা চিঠি। তাহমিনার চিঠি। আশরাফ দুর্বল হাতে ভাঁজ খুলে পড়ল; তাহমিনার সুন্দর হাতের অক্ষরে গোটা গোটা করে লেখা, “আবিদ, তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো। যদি পারো আমাকে ভুলে যেও। ইতি, তোমার তাহমিনা” কোন তারিখ নেই। আর কিছু লেখা নেই। কাগজের উল্টোপিঠ শাদা।
চাবি হাতের মুঠোয় তুলে নিয়ে নিঃশব্দে চিঠিটা এগিয়ে দিল আবিদের সামনে। ঘরের ভেতরে জ্বলছে উজ্জ্বল শুভ্র আলো। আবিদ চিঠিটা মেলে ধরল। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না সে। সমস্ত কিছু যেন এক দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা রয়েছে, কিছুতেই তার অর্থ উদ্ধার করা যাবে না।
এমন সময়ে বারান্দায় পায়ের শব্দ উঠলো। আবিদ উৎকর্ণ হয়ে তাকাল। আশরাফ বলল, আফিয়াকে নিয়ে আসতে পাঠিয়েছিলাম। বোধ হয় এলো। আবদুল কফি আছে?
আছে হুজুর।
এক কাপ কফি কর আবিদের জন্যে।
আবিদ প্রতিবাদ করল। উত্তরে আশরাফ বলল, তোমার দুর্বলতা কেটে যাবে।
আফিয়ার কাছ থেকেই সব খবর পাওয়া গেল। আশরাফ খাটের ওপর বসে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনল। আবিদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। আফিয়া চাবি খুলে দিল আঁচল থেকে, কান্নাধরা গলায় বলল, যাবার সময় দিয়ে গিছল রাক্ষসী।
আর কোন কথা বললো না কেউই। যেন পাথরের মত নিশ্চল নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সবাই। সবাই ভাবছে গভীর মাথা ঝুঁকিয়ে। আবদুল কফি করে নিয়ে এলো।
বাইরে এসে আশরাফ আফিয়াকে বলল, তুমি কি কিছুই বুঝতে পারনি?
আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তাহমিনা যে এমন করে চলে যাবে, কেলেঙ্কারী করবে, তা কে জানতো?
আশ্চর্য।
আমার মন কেমন করছে।
আজ রাতে এখানেই থাকো। আবিদের এমন দুর্বল শরীর কখন কী হয়, কী করে বসে, কে জানে?
সেই ভালো।
তুমি ওকে একটু বোঝাও। নইলে ও সইতে পারবে না।
আফিয়া বিছানা পেতে দিল আবিদের। ছেলেমানুষের মত ধরে শুইয়ে দিল। আবিদ যেন বোবা হয়ে গেছে! আর কোন কথা বলে নি তারপর থেকে। একবার শুধু আফিয়ার হাত ধরে বলেছে, ভাবী, তাহমিনা কিছুই বলে যায় নি?
আফিয়া মুখ ফেরাল চাপা কান্নায়। আবিদ বালিশে মুখ ফিরিয়ে আপন মনেই যেন আরেকবার বলল, তাহমিনা চলে গেছে ভাবী!
আফিয়া স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখানেই থাকো। আমি ও ঘরে খোকাকে নিয়ে আছি।
অনেকক্ষণ পর আবিদ পাশ ফিরে দেখল আশরাফ পাশে বসে আছে।
আপনি যান নি?
তুমি ঘুমোও।
হ্যাঁ, আমি ঘুমোবো।
তোমার খারাপ লাগছে খুব?
না।
তুমি ঘুমোও তারপর আমি যাবো।
আবিদ কষ্টের একটা বিকৃত মুখভঙ্গি করল। আশরাফ একটু এগিয়ে এলো, ব্যথা করছে?
না, এমনি।
আশরাফ বুঝল। একটু পর সে স্নেহের সুরে বলল, তুমি ভেবো না, ও ফিরে আসবেই।
আর সে আসবে না।
তাহমিনা না এসে পারে না। আমি তাকে ফিরিয়ে আনবো। এখনো ও ছেলেমানুষ। তুমি ভেবো না। তুমি ঘুমাও।
আপনি জানেন না। আমি জানি, ও আর ফিরবে না।
তুমি ঘুমোও।
আবিদ পাশ ফিরে শুলো। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল আস্তে আস্তে। তখন সে দরোজা ভেজিয়ে পাশের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। অনেক রাতে আবিদের মনে হলো তাহমিনা যেন পাশে শুয়ে। সে চমকে উঠে দেখল, ভুল। বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠল। ব্যর্থ পৌরুষত্বের প্রতি ধিক্কার এলো। ঘুম তার এলো না। তাহমিনা নেই, সে ভাবতে পারল না। বিরাট শূন্যতা যেন আজ তার চারদিকে। তাকে যেন গ্রাস করে ফেলবে।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আবিদ। পেট্রোম্যাক্স তখনো জ্বলছে, কেউ নিভিয়ে দিয়ে যায়নি। আবিদ কাপড় রাখা আলমিরার কাছে, আলনার পাশে, গিয়ে দাঁড়িয়ে স্পর্শ বুলোলো তাহমিনার শাড়ির ওপরে। অনেকক্ষণ ধরে। তাল পাকানো ছেড়ে রাখা শাড়িটাকে তুলল কিছুটা মুঠোর ভেতরে। নিল তার আশ্চর্য ঘ্রাণ অনেকক্ষণ ধরে। তাহমিনা যে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াত, তারপর সেখানে এসে দাঁড়াল। স্পর্শ করল তার সূক্ষ্ম ঝালর দেয়া পর্দা। আবিদ প্রেতাত্মার মত সমস্তটা কামরায় বিস্ফারিত চোখে কম্পিত হৃদয়ে জেগে রইল।
সে রাতে নাও বাইতে গিয়ে দুএকজন দেখেছে আবিদের নিশুতি বাংলোর শার্সীতে অনেক। রাত অবধি উজ্জ্বল আলো থামের মত নেমে এসে বাইরের মাটি স্পর্শ করে আছে।
.
এরপর থেকে আবিদ শান্ত হয়ে গেছে অসম্ভব রকমে। আর কোনোদিন সে শিকারে বেরোয়নি। সব সময়ে সারামুখে কেমন একটা স্তব্ধতা, ক্লান্তির ছায়া ছড়ানো। কথা বলে খুব কম। ব্যবসার কাজে প্রায় বেরোয় না বললেই চলে। আশরাফ নিজেই এখন সব দেখে। আর মাঝে মাঝেই অনুযোগ করে, তুমি এমন করে থাকলে, শরীর যে টিকবে না।
আবিদ উত্তরে হাসে। ম্লান হাসে। এ সব প্রশ্নের কোনো উত্তর সে দেয় না।
কোনো কোনো সকালে তাকে দেখা যায় দীর্ঘ দুপুর অবধি বারান্দায় ডেক চেয়ার পেতে বসে থাকতে দূর অরণ্যের দিকে। দিনের খবরের কাগজ পাশেই পড়ে থাকে, পড়ে না। কিংবা হয়ত বিকেলে বসে চেক–বোর্ড নিয়ে। একেলাই খেলে। অনেক রাত হয়ে যায় তবুও ওঠে না। মাঝে মাঝে অনেক রাত্তিরে তাকে দেখা যায় ডান পা একটু টেনে টেনে বেডল্যাম্প হাতে বাংলোর প্রত্যেকটি কামরা ঘুরে বেড়াতে।
কয়েকদিন একেলা বেরোয় সমুখের পথ দিয়ে। অনেকদূর অবধি চলে যায়। আফিয়া তার জানালা দিয়ে দেখে, কিন্তু ডেকে বসাতে সাহস পায় না। মনে হয় মানুষটা যেন কাঁচের তৈরি, সামান্য স্পর্শেই চুর চুর হয়ে যাবে। কোনো কোনোদিন আফিয়া আসে বাংলোয়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তত্ত্ব নেয় আবিদের। আবদুল আর খানসামাদের মৃদু তিরস্কার করে কোনো ভুলের জন্য। বারবার করে বলে যায় ভালো করে লক্ষ্য রাখবার জন্য। দাঁড়িয়ে থেকে ঘর গুছিয়ে দিয়ে যায়। বদলে দিয়ে যায় ফুলদানির ফুল।