.
নৌকোঘাটায় আবিদ স্টিকে ভর করে আস্তে আস্তে নেমে এলো আশরাফের সাথে। অ্যাশ শেড উলেন ট্রাউজার পরনে। আর মেরুন রঙের শার্ট। ক্রোম মেটালিক স্টিক হাতে। আগের মতই দীর্ঘ, সবল, আর উদ্ধত। দেখে চট করে বোঝা যায় না যে এতবড় একটা বিপর্যয় তার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। ভেতরে ঢুকে বলল, গফুর, আমি একটু শোবো।
.
ঘাটে এসে যখন নৌকা ভিড়ল তখন প্রায় সন্ধ্যে। এখন শুধু স্টিকে ভর করে আবিদ হাঁটতে পারল না, আশরাফের কাঁধে সে হাত রেখে ভর করল। যেতে যেতে জিগ্যেস করল, আলো দেখছিনে বাংলায়? এখনো জ্বালে নি নাকি?
জ্বলবে হয়ত।
এতক্ষণে তো পেট্রোম্যাক্স জ্বলার কথা।
হ্যাঁ। তোমার অসুবিধা হচ্ছে নাতো?
না। একটু।
বাংলোর কাছে এসে অবাক হলো আশরাফ। সারাটা বাংলো ঘিরে এক অশুভ নির্জনতা। আলো নেই। কেউ নেই। কেমন থোকা থোকা অন্ধকার ছড়িয়ে আছে ইতস্তত। সে বলল, গফুর টর্চটা তুই ধর। আমি ওকে নিয়ে ওঠছি।
গফুর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল টর্চ নিয়ে। জ্বালালো। আশরাফ আর আবিদ উঠে এলো। বারান্দায়। আবিদ বলল, কারো সাড়া পাচ্ছিনে, কি ব্যাপার?
কী জানি। আমার ওখানে যায়নি তো!
ভেতরের বারান্দা ঘুরে যেতে সে আবদুলের নাম ধরে দুবার ডাকল।
আবদুল হারিকেন হাতে প্রায় ছুটে এলো। হুজুর এসেছেন?
আশরাফ শুধালো, মেমসায়েব কই? উনি কই?
তিনি তো আজ তিনদিন হলো সদরে গেছেন!
আর প্রায় সাথে সাথে আবিদ উত্তেজিত স্বরে জিগ্যেস করল, কে? উনি কে?
সাথে সাথে প্রলয় ঘটে গেল যেন। আবদুল একে একে বলে গেল সব কথা। ফারুকের আসবার কথা থেকে তাহমিনা আর তার ভোরে চলে যাবার দিন অবধি। আশরাফ হতভম্ভ হয়ে গেল। আবিদ স্তম্ভিত হয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল। এক মুহূর্তের জন্য কিছুই সে ভাবতে পারল না। কিছুই করতে পারল না। কেবল একটা অদ্ভুত বিস্মৃতি এসে তাকে আচ্ছন্ন, অবশ করে ফেলল যেন। সন্ধ্যার ধূসর অন্ধকারে ভালো করে তার মুখ দেখা গেল না। সে আশরাফের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে চিৎকার করে উঠল, কেন আপনি চলে গেলেন এখান থেকে? কি হত আমার অমন দুদশটা অর্ডার নষ্ট হলে? আমাকে কেন জানালেন না ফারুকের কথা? কী ভরসায় রেখে গেলেন সব একলা ফেলে? কেন? কেন?
আবিদ তুমি থামো।
ততক্ষণে আবিদ তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
তাহমিনা নেই। আবদুল, তুই যেতে দিলি কেন?
হুজুর।
আবিদ, থামো। অসুখ বেড়ে যাবে তোমার। আমি দেখছি সব।
আর কী দেখবেন আপনি?
বলতে বলতে আস্তে আস্তে থেমে গেল আবিদ। যেন আর কিছু তার বলবার নেই। সে কী যেন বুঝতে পারল। ঠোঁট কাপল কিছু বলবার জন্য, কিন্তু সে কিছুই বলতে পারল না। আশরাফের দিকে, আবদুলের দিকে সে দৃষ্টি ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল।
আবদুল শোবার ঘরের তালা ভেঙে ফেলল একটু পরেই। জ্বালল পেট্রোম্যাক্স। আশরাফ দুজন খানসামাকে ডেকে আফিয়াকে নিয়ে আসতে পাঠালো। সাথে গেল গফুর। আরো বলে দিল, খোকাকেও যেন নিয়ে আসে। আজ রাতে এখানেই হয়ত থাকতে হবে। আশরাফের সমস্ত ব্যাপারটা লাগছিল দুঃস্বপ্নের মত। তাহমিনার ওপর ভীষণ রাগ হলো তার। সমস্ত স্নেহ আর মমতা নিমেষে মুছে গেল তার ওপর থেকে। কেন সে এমন করল? কেন সে ফারুকের সাথে পালিয়ে গেল? কিসের অভাব ছিল তার? নিজে দেখে তাহমিনার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল সে, তাই নিজেকে আজ বড়ো অপরাধী বলে মনে হলো তার। পর মুহূর্তে ভাবল, এমন তো নাও হতে পারে। কিন্তু সে দুরাশা শুধু মুহূর্তের জন্য। এ হচ্ছে এমন কিছু যা দুরাশারও অতীত।
আবদুল শোবার ঘরে নিয়ে গেল পেট্রোম্যাকস। আবিদ আর আশরাফ ঢুকলো তার পেছনে পেছনে। আবিদ প্রথমত ভয়ে তারপর যেন ঘৃণায় ভালো করে তাকাল না কোনদিকে, কী জানি কি চোখে পড়ে যায়। চুপ করে সে ঠায় বসে রইল। তারপর এক সময়ে তার বিস্ফারিত চোখ ঘুরে বেড়াতে লাগল তার অজান্তে মরার সর্বত্র। খাটের বালিশে এখনো মাথা রাখবার গভী: ভাঁজ। চাদরটা এলেমেলো হয়ে পড়ে আছে। তাহমিনা ভোরে উঠে যেমন রেখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি। আলনায় এখনো তার তাল পাকানো ছেড়ে রাখা কয়েকটা শাড়ি লুটিয়ে পড়ে আছে। আর কয়েকটা ধোয়া শাড়ি, চোলি আর ব্রা। এখনো ভাঁজ ভাঙা হয়নি তার। তাহমিনা পরেনি। নিচে কয়েক জোড়া স্যাণ্ডেল আর চটি—- তাহমিনার পায়ের ভারে কোনটায় আঙ্গুলের আবছা দাগ পড়েছে আবিদ তা জানে। আজ হঠাৎ তার মনে হলো কখন সে সব কিছুই জেনে ফেলেছে গাঁথা হয়ে রয়েছে তার মনে। আলমিরায় থরে থরে সাজানো তার কাপড়। কোনটায় তাকে মানাতো এখন স্পষ্ট হয়ে মনে পড়ল। আর মনে পড়ল ভীষণ লাল সেই চোলির কথা—-আঁটসাঁট বাঁধা পড়ত যাতে তার সুগৌর সুন্দর স্বাস্থ্য। সবচে মানাত তাকে ওই চোলিতে। সেটা বুঝি আলমিরাতেই রাখা। যে সোফায় সে বসে রয়েছে সেখানে হয়ত শেষবার বসেছিল তাহমিনা। ছোট্ট টেবিলের ওপর তাহমিনার ফটো কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। আর তার পাশে নিভিয়ে রাখা, কিছুটা ধোঁয়ায় ম্লান হয়ে যাওয়া বেডল্যাম্প। আর বাতাসে যেন তাহমিনার গাত্রসৌরভ মিহি প্রসাধনের ভারী ঘ্রাণ। সমস্ত ঘরে প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে আছে তার স্পর্শ। শুধু সে নেই। অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো তার। মনে হলো এখুনি সে ফিরবে। তাহমিনার চিবুকের আঁটি পর্যন্ত তার মনে আছে। আর ওই জানালায় তাহমিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখত। টুকরো টুকরো ছবির মত সমস্ত চিত্র এসে উঘাটিত হলো তার সমুখে। মিলিয়ে গেল। আর চারদিকে তাহমিনার স্পর্শ এত গাঢ় যে বুঝি হাত দিয়ে ধরা যায়। আবিদের এখন ইচ্ছে হলা হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে উঠে বিকট বিভৎস একটা হাসিতে সব কিছু ডুবিয়ে দিতে। কিন্তু তার ভয় হলো। মনে হোলো সমস্ত শক্তি যেন তার লুপ্ত হয়ে গেছে। তার সাহস হারিয়ে গেছে।