পথে এসে অনেকক্ষণ পরে যখন আশরাফদের কুঠি আর দেখা গেল না তখন তাহমিনা বলল, শেষ সম্পর্ক চুকিয়ে এলাম।
তালা লাগাবে কী করে?
সব টিপ-তালা। বাংলোর চাবি আবদুলের কাছেই থাকবে। বড় বিশ্বাসী লোক। ফারুক একটু পর শুধালো, সেফড্রয়ার, আয়রন চেস্টের চাবি?
সেগুলো কি নিয়ে যাবো ভেবেছ? তাহমিনা উত্তর করল, তোষকের তলায় রেখে গেলেই ও পাবে।
.
সেদিন সারারাত দুজনের কারুরই ঘুম এলো না চোখে! শুধু অরণ্যের বিচিত্র শব্দ আর স্রোত বয়ে যাওয়ার একটানা ধ্বনি। আকাশ পাতাল ভাবল দুজনে দুকামরায় শুয়ে থেকে এপাশ ওপাশ করে। তাহমিনা আবদুলকে সন্ধ্যেয় ইয়াসিন মাঝিকে খবর দিয়ে রাখতে বলেছে। সকালে সে যেন আসে। ফারুক গুছিয়ে রেখেছে তার জিনিসপত্র। অনেকরাত অবধি বাতি জ্বলেছে তাহমিনার ঘরে। মাঝখানে ঘরে রাখা কাঁচের কুঁজো থেকে দুবার পানি গড়িয়ে খেয়েছে ফারুক। তারপর আবার শুতে গেছে বাতি ছোট করে। কিন্তু ঘুম আসে নি। কারা যেন কী ষড়যন্ত্র করছে কোথায়, ফিসফিস করে কথা কইছে–ফারুকের মনে হতে লাগল রাত্রির মিলিত ধ্বনি এমনি রহস্যময়। কান পেতে সে শুনেছে কেবলি।
অবশেষে একসময়ে কিছুই যখন তার ভালো লাগল না, যখন শুধু ইচ্ছেটুকু রইলো তখন সে আস্তে আস্তে উঠে এলো। তারপর তাহমিনার উষ্ণতাকে নরোম বলের মত বুকে তুলে ঘুমিয়ে পড়ল ফারুক।
.
ঘুম যখন ভাঙলো তখন ভোর রাত। আকাশে শেষ রাতের শেষ তারা। পুব আকাশে কালচে লাল প্রহর। ইয়াসিন এলো। আবদুল উঠল একটু পরেই। বেশি কিছু কথা বললো না কেউই। তালা লাগিয়ে তাহমিনা মুখ ফিরিয়ে বলল, সাবধানে থাকিস আবদুল? রাতে খোকাদের ওখানে থাকবি।
আচ্ছা। কবে ফিরবেন?
কয়েকদিন পরে।
বলতে গিয়ে কেমন গলা কেঁপে উঠল তার। তাড়াতাড়ি সে বাড়ালো। বলল, ওগুলো হাতে নে আবদুল, ওরা যাক। তারপর ফারুকের দিকে ফিরে বলল, চল।
১৩. এ কাহিনীর শেষ এখানেই নয়
কিন্তু এ কাহিনীর শেষ এখানেই নয়। তেঁতুলিয়ার শাখা নদীর উজানে ইয়াসিন মাঝির নৌকোয় পলাতক দুজনকে যাত্রা করিয়ে হয়ত এ কাহিনীর সমাপ্তি টানা যেত কিন্তু দেড় বছর পরের আর একটি কথা যদি না লিখি তাহলে গোটা কথাই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। এর প্রস্তুতি হিসেবে গোটা কয়েক ছোট ঘটনা বলা দরকার।
ছনম্বর প্লট থেকে আশরাফের কাজ শেষ হলো দিন পাঁচেক পরে। সদরে সামান্য কাজ আছে, তাছাড়া আবিদকে একবার তার দেখে আসা দরকার।
নৌকোঘাটায় বোট বাঁধল গফুর। আশরাফ নেমে এলো। হাসপাতালে ঢুকতেই বারান্দায় দেখা আবিদের সাথে। একটা লাঠি ভর করে রেলিংয়ের কাছে সে দাঁড়িয়েছিল। আশরাফ এগিয়ে এসে শুধালো, কেমন আছ এখন? বেরিয়েছ দেখছি।
আবিদ ম্লান হেসে উত্তর করল, হ্যাঁ। ভালো, অনেকটা ভালো। স্টিক ভর করে চলতে পারছি কাল থেকে।
আর কদ্দিন লাগবে?
প্রায় তো ভাল হয়েই এলুম। তবে ডান পা বোধ হয় দুর্বল থেকেই যাবে। স্টিক ছাড়া হাঁটতে পারব বলে আর মনে হচ্ছে না।
তবু ভালো।
তারপর ওর কাঁধে স্নেহের ভঙ্গিতে হাত রেখে বলল একটু পরে, কী বলছ তুমি। কিছুদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আবিদ একহাতে ওকে ধরে বেডের দিকে এগুতে এগুতে বলল, দাঁতটা বসিয়ে ছিল জোর। এমন কোনদিন আর হয়নি। ভাবলে এখনো মনে হয় বুঝি রক্তপাত হবে। কদিন এত যন্ত্রণা ছিল যে শুধু ভেবেছি, আবদুল যখন গুলি করল তখন কুমিরের গায়ে না লেগে আমাকে বিধলে ভালো হোতো।
থাক ওসব কথা। বেশি কথা বোলো না।
আবিদ বেডে এসে শুয়ে পড়ল। পাজামা তুলে পাটা দেখাল একবার। তারপর চুপ করে পড়ে রইল। সারা কামরায় শুধু শুভ্রতা। আর ওষুধের একটা ঝাঁঝালো মিশেল গন্ধ। ধবধবে পর্দা টাঙানো দরোজায়, জানালায়। বেডের পাশে একটা ছোট টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানিতে কয়েকটি ফুল। আজ সকালেই বদলানো হয়েছে। আবিদ একটা ফুল তর্জনী আর মধ্যমার ভেতরে রেখে দোলাতে দোলাতে শুধালো. সোজা সদরেই এলেন?
না, দিন পাঁচেক আগে বেরিয়েছি। গিছলাম ছম্বর প্লটে। কয়েকটা বড় অর্ডার ছিল, সে ব্যাপারে দেখাশোনা করতে। সেখান থেকেই সোজা ফিরছি।
কোন ফার্ম থেকে?
চাটগাঁর সেই বড় পার্টি।
আবিদ একটুকাল ভ্রু কুঁচকে ভাবতে চেষ্টা করল তারপর বলল, ও।
আশরাফ চাদরের একটা ভাঁজ নখ দিয়ে মিলিয়ে দিতে দিতে বলল, তাহলে ভালোই আছো এখন। তাহমিনা আর আসে নি?
না।
ও।
কেমন আছে ওরা?
ভালো সবাই।
আবিদ তাহমিনার মুখ মনে করতে চেষ্টা করল। এ কদিন কি করেছে ও? তারপর আর একবারও এলো না সে আবিদ ভাবল। আবিদ এত অপেক্ষা করেছে তার জন্যে।
আশরাফ বলল, তাহলে আজকেই তোমাকে নিয়ে যাই।
আমিও তাই ভাবছি।
আশরাফ বুঝল আবিদ বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ভালো লাগছে না তার হাসপাতালে। তাই আর সে কোনো কথা না বলে ঐ কথা বলল। তারপর উঠে গেল সার্জেনের কামরায়। একবার ভেবেছিল ফারুকের কথা বলে আবিদকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ভেবেছে, এখন বেশি বকানো ভালো হবে না। তাই আর কিছুই বলেনি।
সার্জন যা বললো, এক কথায় তার মানে দাঁড়ায় এই যে, এখন অবশ্যি আর কোন ভয় নেই, ঘা প্রায় শুকিয়ে আসবার পথে, তবে শরীর বড় দুর্বল। আর কিছুদিন রাখতে পারলে ভালো, তবে নিয়ে গেলে কোনো ক্ষতি হবে না—- প্রেসক্রিপসন ফলো করলেই চলবে। তিনি সময় পেলে মাঝখানে নিজে একবার গিয়ে দেখে আসবেন। আশরাফ ধন্যবাদ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলে গেল, বাইরে কাজ সেরে আজ বিকেলেই ওকে নিয়ে যাবে।