ঢাকায় কোথায় উঠবো আমরা?
এতবড় শহরে এতটুকু জায়গা হবে না? হবে চল ফারুক, আর দেরি করো না। তাহলে কোনদিনই আর হবে না। তারপর একটু থেমে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, কাল সকালেই আমরা যাব।
কাল?
হা কাল।
নিস্তব্ধতা।
আমাকে সাহস দাও ফারুক।
ফারুক ওর শুভ্র কপোলে সংক্ষিপ্ত ঠোঁট ছুঁইয়ে গাঢ় স্বরে বলল, হ্যাঁ আমরা কালই যাবো।
.
বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিল আফিয়া। খোকা একদৌড়ে তার কাছে গিয়ে বলল, এসেছে আম্মা।
ধরে আনলি, না? তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বলল, না ডাকলে আসতে নেই বুঝি? এদিক দিয়েই তো যাচ্ছিলে।
আসব না কেন? আসতুম। জানেন থোকা আমাকে গিয়ে এই এই বলে ডাকছিল।
খোকা লজ্জায় পালিয়ে গেল। আফিয়া সেদিকে তাকিয়ে বলল, দুষ্ট। তারপর ফারুকের দিকে তাকিয়ে, বেড়াতে বেরিয়েছিলো বুঝি?
জি। আপনাদের এদিককার হাট দেখবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পা রাজি হোলো না খানিক দূর গিয়ে।
তাই বুঝি ফিরে যাচ্ছিলেন? শহুরে মানুষের কিন্তু ওই এক দোষ, হাঁটতে পারে না। ওমা, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? ভেতরে আসুন।
ফারুক ভেতরে যেতে যেতে বলল, এ অনুযোগ আপনার মিথ্যে। আমি না হয় শহুরে মানুষ, আপনারা তো নন। ওরো তো একই অবস্থা।
দ্যাখ দিকি, মেয়ে মানুষ কি হেঁটে অভ্যেস?
ফারুক আর আফিয়া এবার হেসে উঠলো। তারপর হঠাৎ আফিয়া উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, যাই একটু চা বলে আসিগে।
উঁহু। ফারুক বলল, খেয়ে এসেছি।
তাহমিনাও কি তাই বলবে নাকি?
আপনি শুধু শুধু কষ্ট করছেন।
ভারী তো কষ্ট। দরদ থাকে কষ্টের ভাগ নাও না?
আফিয়া বলতে বলতে হেসে ফেললেন। হাসতে গিয়ে গালে টোল পড়ল। তাহমিনাও হেসে বলল, অত দরদ আমার নেই। যান, চট করে আসুন।
ফারুক বলল, অবাক হই, এই পাড়াগাঁয়ে জঙ্গলের ভিতরে এত চার জোগাড় কী করে করেন। আশ্চর্য কিন্তু।
আশ্চর্য আবার কী! আর এটা বুঝি বুনো পাড়াগা?
তাছাড়া কী?
বেশ, বেশ। ঢাকায় আছে নাকি আপনাদের তাহমিনাদের মত বাংলো। মেলাই তো সব দালান কোঠা শুনি!
তা নেই।
তবে?
তাহমিনা আফিয়া যখন যাচ্ছিল তখন বলল, খোকাকে নিয়ে আসবেন ধরে। ডেকে এনে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এমন দুষ্ট ছেলে।
একটু পরেই ফিরে এলো আফিয়া। সারা মুখে গৃহিনী সুলভ একটা তৃপ্তির ছায়া ছড়ানো। ঘরের কোণ থেকে নিচু টেবিল মাঝখানে সরিয়ে আনতে আনতে বলল, খোকা তোমার এলো না। লজ্জা পেয়েছে।
তাই বুঝি? দাঁড়ান আমি নিয়ে আসছি। কই ও?
ওইতো বাইরে
তাহমিনা বেরিয়ে গেল। ফারুক তাকিয়ে রইলো চলে যাওয়া তার দিকে। একটুখন পরে খোকাকে প্রায় কোলে করে ফিরে এলো সে। বলল, কই কেমন লজ্জা করছে দেখি। কিরে? আপা বলবিনে।
খোকা মুখ ফিরিয়ে নিল।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প করল ওরা এটা সেটা। আফিয়া অনুযোগ করল, আর একটু পুডিং নিক না ফারুক। তাকে নিতেই হলো। তাহমিনা প্রায় কিছুই নিল না। শুধু চা। পুডিং সবটা দিল খোকাকে।
একসময়ে আফিয়া তাহমিনাকে শুধালেন, সদর থেকে আর কোন খবর পেলে ওর?
তাহমিনা একমুহূর্ত নীরব থাকল। তারপর হাত থেকে পেয়ালা নামিয়ে বলল, পেয়েছি।
কেমন আছে এখন?
আফিয়ার উদ্বিগ্ন প্রশ্নের উত্তরে সে বলল, ভালোই! কাল সকালে আমাকে যেতে হবে।
আফিয়া কিছুই বলল না, শুধু সেই উদ্বিগ্নতা আঁকা রইল সারামুখে। আর ফারুকের হৃদস্পন্দন যেন হঠাৎ থেমে আবার শুরু হলো। মনে পড়ল একটু আগে তাদের দুজনার কথা, কাল তারা পালিয়ে যাবে সেই কথা। তাহমিনা মিছে কথা বলল, কিন্তু স্বর তার কাপল না এতটুকুও। এত তাড়াতাড়ি এত সহজে অমন সোজা একটা পথ যে বেরিয়ে যাবে তা ওর ধারণাতীত। কাল সকালেই যে কী করে ওরা বেরুবে, সেটাই ওর একটু আগে ছিল ভাবনা। এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। আফিয়া শুধালো, কাল সকালেই যাচ্ছো?
হ্যাঁ।
আর উনি?
ফারুকের দিকে চকিত চোখ তুলে আফিয়া শুধালো, ও-ও আমার সংগে যাচ্ছে। ঢাকা যাবে।
তাই নাকি? এদিকে আমি কিছুই জানিনে। শুনেছিলুম, কিছু দিন নাকি থাকবেন।
না, কালকেই যাচ্ছেন।
ফারুককে শুধালো, তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। আবার এসে কিছুদিন থেকে যাবো।
আফিয়া সহসা গম্ভীর হয়ে গেল। একটু আগেই হেসে হেসে কথা বলছিল, এখন মন তার ভারী হয়ে এলো। তিনজনেই চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। এমন কি খোকাও। তারপর তাহমিনা বলল, এবারে যেয়ে ফিরতে দেরি হবে ভাবী। ওকে হয়ত সাথে নিয়েই ফিরব তাই।
ও।
তাহমিনা আঁচল থেকে ছোট্ট একটা চাবির ছড়া খুলল। বলল, এটা আপনার কাছে রইল। খোকার বাবা কাল পরশু ফিরতে পারেন। হয়ত কাগজপত্রের ঘর খুলতে হবে।
তাই বলে—-
আপনার কাছেই থাক। আর কাব কাছে দিয়ে যাব? যদি একদিন দেরি হয় তখন? সে ভয়ানক অসুবিধে হবে। তারচে থাক।
আফিয়া চাবির ছড়াটা হাতে নিলেন। বলল, কেন জানি, মন কেমন করছে আমার। ভালোয় ভালোয় ওকে নিয়ে ফিরে এসো।
তাহমিনা বলল, আবদুল এসে আপনার এখানে থাকুক উনি না আসা অবধি। বাংলোয় আরো সকলে থাকবে, কিছু হবে না। আমি আসি তাহলে ভাবী।
তাহমিনা উঠে দাঁড়ালো। ফারুকও। বিদায় নিল সে আফিয়ার কাছ থেকে। আফিয়া আবার তাকে আসতে বলল। তাহমিনা বেরিয়ে এসে খোকার পাশে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল, কিরে আপা বললিনে? একবার বলত আপা।
একটু পরে খোকা তার কানের কাছে মুখ রেখে বলল, আপা। সাথে সাথে তাহমিনা ওকে প্রায় জড়িয়ে ধরে আদর চুমু দিল। তারপর বেরিয়ে এলো।