আশরাফের ছোট্ট ছেলে খোকা এবার লজ্জিত হলো। ছাড়িয়ে যেতে চাইল তাহমিনার আদর বাহুবন্ধনকে। সে উঠে দাঁড়িয়ে সুন্দর গ্রীবাভঙ্গি করে শুধালো, যাবে নাকি?
যাবে? চল।
বিকেলে বেরিয়েছিল ফারুক আর তাহমিনা। বাংলোর সমুখ দিয়ে যে পথ গেছে সেই পথ। ধরে। আধমাইলটাক গেলে পর হাট পড়ে। সেই হাটে যাবে।
পড়তি দুপুর বেলায় যখন ফারুক পেছনের বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিল তখন তাহমিনার সাথে দেখা। একটু গড়িয়ে মুখে চোখে পানি দিয়ে ফিরছিল ও। পিঠের ওপর এলিয়ে দেয়া চুল চিকচিক করছে একটু। শাড়ির আঁচল সারা গায়ে আঁট জড়ানো। ও বলেছে, হাট দেখতে যাবে নাকি? বলছিলে যে তখন।
চল না, বেশ হয় তাহলে। কখন?
আর একটু পরে। তৈরি হও তুমি।
তাহমিনা পড়ল রূপোলি তারা বসানো সাদা শাড়ি–রূপোলি বর্ডার দেয়া। আর ফারুক পরল তার সবচে হালকা পোশাক—-গলা খোলা পাঞ্জাবি আর পাজামা। জরির কাজ করা স্যান্ডেল জোড়া পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে এলো। তাহমিনা বলল, যাই বলো, চিরকাল তুমি সৌখিন মানুষ।
নাকি?
ফারুক হাসলো। তারপর কেমন ধীরে ধীরে দুজনে ধরল পায়ে চলা পথ। কিছুক্ষণ হাঁটবার পর ফারুক বলল, এক মধুপুরের গড় ছাড়া অরণ্য আমি কোনোদিন দেখিনি।
সুন্দরবন তোমার ভালো লাগবে। তোমার মনের মত জায়গা।
কেন বলো তো? ফারুক শুধালো।
তাহমিনা ভ্রূ নাচিয়ে উত্তর করল, অরণ্যের প্রতি তোমার আশ্চর্য দুর্বলতা আছে। মনে পড়ে কবিতা লিখেছিলে?
হাসল ফারুক। বলল, ভুলিনি। একটা মজার কথা মনে পড়ল। হালি একবার কি লিখেছিলেন জানো? ওয়ার্ডম্বার্থকে যদি ঘন ট্রপিক্যাল ফরেস্টে ছেড়ে দেয়া হতো, তাহলে তার কাব্যিপনাও নিমেষে শিকেয় উঠে যেত।
প্রত্যুত্তরে তাহমিনা মৃদু হাসি ছড়ালো সারা মুখে।
আরো কিছুক্ষণ চলবার পর ফারুক বলল, কাল রাতে আমার মন কেমন করছিল।
কখন?
শুতে এসে।
কী হয়েছিল?
কেউ যদি জেনে ফেলত?
তাহমিনার গতি শ্লথ হয়ে এলো। একটু পরে সোজাসুজি তাকিয়ে কোমল স্বরে শুধালো, তুমি অনুতপ্ত?
না, তাহমিনা।
তারপর নীরব হয়ে গেল দুজনেই। আরো কিছুক্ষণ চলবার পর তাহমিনা বলল, ওখানে না গেলেই নয়?
কী এমন।
তাহলে থাক। আরো অনেকটা হাঁটতে হবে। এরচে একটু বসিগে কোথাও।
কোথায় বসবে? ফিরতে হবে কিছুদূর, ফেলে এসেছি পেছনে।
একটা চেনা জায়গা আছে আমার। চল।
কাজ নেই তাহলে।
আবার ওরা ফিরতি পথ ধরলো। হাটমুখে চলেছে দুএকজন লোক। কাঁধে তাদের হাটের পশরা। একজনের কাঁধে বাঁকের দুধারে সাবানের বাক্স ঝোলানো। ফারুক জানে মনোহারি জিনিসে এটা সেটায় ভর্তি বাক্স দুটি। চার পয়সা দামের, গোল আয়না থেকে শুরু করে ছআনা দামের বিরহ–মিলন পত্রাবলী অবধি। কাঁচা ঝিয়াড়ীর মনকাড়া কাঁচের চুড়ি আর শস্তা সুগন্ধ। গ্রামের হাটে বিক্রি হতে চলেছে। লোক কজন তাহমিনাকে দেখে সালাম করল। তাহমিনা দিল তার প্রত্যুত্তর মিষ্টি হেসে। একজনকে শুধালো, ভালো আছো?
ফারুক বলল, তোমাকে ওরা চেনে দেখছি।
বাঃ চিনবে না। তারপর বলল, ভারী সরল মানুষ ওরা। তোমরা শহরে লোক তা ধারণাও করতে পারবে না।
পথ থেকে নেমে ডান হাতে কিছুদূর এগিয়ে এলে—-এদিকে খুব বেশি কেউ যাতায়াত করে না—- একটা ফাঁকা জায়গা চোখে পড়ে। একটা নিচু জমিতে জমেছে পানি। তারি খাড়াইয়ে একটা বিরাট বুনো গাছ। আর তারি ছায়ায় বসলো দুজনে।
একটা ছোট্ট মেঠো ফুলের গাছ তুলে ফেলতে ফেলতে ফারুক শুধালো, এর পরে কী করবে তুমি?
আমাকে কেন সে কথা জিগ্যেস করো।
তবুও।
আর তবুও না ফারুক।
এতটুকু আবেগ নেই তাহমিনার বলনে। অত্যন্ত একটা সাধারণ কথা যেন বলছে এমনি তার সুর। ফারুক তার মুখের দিকে তাকাল। তাহমিনা বলল, আর কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
ফারুক কোনো উত্তর করল না।
তোমার ভয় করছে ফারুক?
না।
তুমি সব শুনেছ। সব তোমাকে বলেছি। জোয়ার যখন আসে তখন ভয় করলে চলে না। আমি তুলে দিইছি আমার সবকিছু তোমার হাতে। তুমি আমাকে বাঁচাও। আমাকে ভালোবাসা দাও।
আমি ভালবাসি তাহমিনা।
চল আমরা চলে যাই।
কোথায়?
যেখানে খুশি। ঢাকায়।
তাহমিনা!
আমাকে তুমি নিয়ে যাও। না কোরো না। তোমাকে পেয়ে আমি বাঁচতে চাই।
ফারুক এতদূর ভাবে নি। তাহমিনা যে তার সাথে যেতে চাইবে, তা সে ভাবতেও পারেনি। কিন্তু তাহলেও সে ফিরতে পারত না। এখন ফেরবার আর পথ নেই। একেলা সে ফিরে যেতে পারবে না। আর কী করেই বা যাবে? তাহমিনার কষ্ট হোক, তাহমিনা তিলে তিলে মরে যাক, সে সহ্য করতে পারবে না। তাছাড়া যদি কিছু হয়? তাহলে?
আর তাহমিনা শুধু তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে কিছুই ভাবতে পারল না। এমন জীবন সে চায়নি। আবিদের কথা একবারও তার মনে হোলো না। যেন কোন দিন তাকে সে চিনতো না। ফারুক কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না। সে দেবে না। সে তার ভয় ছিনিয়ে নেবে।
দূরে কারা হেঁটে গেল। তাদের স্বর শোনা গেল। হয়ত হাট থেকে ফিরছে মানুষেরা। ফারুক ভাবলো, না সে তাকে ফেলে যাবে না এই দেয়ালের দেশে। কিন্তু কী করে ফিরে যাবে ঢাকায়? তার মা, মা রয়েছেন। কোথায় উঠবে তার? মালেকাবাণু, জাকি, লাবলু, ওদের কথা না হয় ছেড়ে দিল। তার নিজের মাকে সে গিয়ে কি বলবে? ফারুক আস্তে আস্তে বলল, আবিদ আবিদ যদি কিছু করে।
তাহমিনা উত্তরে বলল, তুমি পাগল। আবিদকে আমি চিনি।