তার এক মুহূর্ত আগেই বুঝতে পেরেছে ফারুক। কোমল শব্দ উঠল সোফা থেকে। তাহমিনা স্বপ্নের ভিতর থেকে শুনতে পেল তার পদশব্দ। সে শুনলো।
ক্ষণকাল সে নিশ্বাস বন্ধ করে পড়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে সে ঠোঁট খুলল। মুখ নামিয়ে আনল ফারুক। এক হাতে নিভিয়ে দিল ল্যাম্প। অনেকক্ষণ। ফারুকের হাত তার খোঁপার গভীরে। আর. একটা হাত তার পিঠের আড়ালে। অনেকক্ষণ পড়ে রইল তারা। মোআনা মেলডি যেন হাজার মাইল দূর থেকে ভেসে আসছে এই অন্ধকার কামরায়।
চোখ মেলল তাহমিনা। হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল তারা খাটের কেন্দ্রে। ফারুকের কপালে স্বেদবিন্দু। চোয়ালের হাড় ফুটে বেরিয়েছে। কঠিন হয়ে গেছে। সে তাকে বাহুবন্ধনে বাঁধল। আর তারপর তাহমিনা তার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখল অন্ধকার সিলিং। কাঠের বিমগুলো দূরে, প্রায় একটি বিন্দু থেকে, দ্রুত সমুখে এগিয়ে এসেছে এসে তার দেহের দুদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ফারুকের কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে তার চিবুকের নিচে সিফনের মত যে বঙ্কিমতা—- তাহমিনা অনুবভ করল এক আশ্চর্য নদীর হঠাৎ প্রবাহ। গেল। কিন্তু তাকে কৃতজ্ঞ করে দিয়ে গেল। যা সে পায়নি, এতকাল, পায়নি এমন কি যা পাবার আশা সে ছেড়ে দিয়েছিল, তা যেন হঠাৎ কেউ তাকে দুহাত ভরে দিয়ে গেল। কৃতজ্ঞতায়, তৃপ্তিতে, মুক্তিতে, বিশ্বাসের অসীমতায় মুহূর্তকাল আগে কঠিন হয়ে আসা শরীর তার কোমল কোমলতর হলো কেবলি। এমন কী তার মনে হলো, ঠিক এমনি করে, এই রাত্রি এই সময়ের অনন্ত পেরিয়ে, সে কেবলি রূপান্তরিত হবে কোমলতায় বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্নতর হবে কোমলতায় প্রসারিত হবে সমস্ত অনুভূতি শাসিত মহাদেশে এবং তখন তার এই অস্তিত্ব থাকবে না, কিন্তু থাকবে তার অলৌকিক বিশাল কোমলতার মত এই কেবলি ছড়িয়ে পড়া, বিস্তৃত হওয়া একটি অস্পষ্ট কিন্তু সীমাহীন বিস্তৃতি।
এর বহুক্ষণ পরে নিজেকে মুক্ত করে উঠে বসলো তাহমিনা। কানের ঝুমকো ঠিক করতে করতে তাকাল ফারুকের দিকে। পাশেই সে শুয়ে। মাথার পেছনে তার হাত জোড়া করে রাখা। চোখ অলস মোদিত। কপালে সেই স্বেদ বিন্দু ঘন হয়ে দেখা দিয়েছে। তাহমিনা জানে তার কানের পেছনেও আঁকাবাঁকা রেখায় স্বেদ এখন গড়িয়ে যাচ্ছে। দুজনে তারা পরস্পর তাকিয়ে রইল। ফারুক জড়িত গলায় বলল, আমি তোমাকে ভালবাসি তাহমিনা। তারপর ওকে আবার আকর্ষণ করে, বক্ষের সন্ধিস্থলে চুমো আঁকল। তাহমিনা মৃদু দোলায় এগিয়ে এলো আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে। সে তার উত্তাপ, তার ভালোবাসাকে অনুভব করতে চায়। নিঃশেষ করে দিতে চায়।
.
নিঃশব্দে দরোজা খুলে পায়ের পাতার ওপর ভর করে বেরিয়ে এলো ফারুক আর তাহমিনা। তাকাল ইতস্তত করে। অন্ধকারে আবদুলের ঘরেও বাতি নেই। বাতাস বইছে পাতার ভিতর দিয়ে। হিম হিম বাতাস। ভালো লাগা বাতাস। ফারুক ফিসফিস করে শুধালো, কেউ জেগে নেই তো?
দূর।
আবদুল?
কখন ঘুমিয়েছে। তা ছাড়া শোনা যায় না।
আমার খেয়াল ছিল না।
আমারও না।
ল্যাম্প হাতে করে তাহমিনা বাথরুমে ঢুকে দরোজাটা আস্তে শুধু ভেজিয়ে দিল। ফারুক বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকারে। একটু পরে কানে এলো তার সাবধান পানি ছিটানোর শব্দ। তারপর সাবান ফেনায় হাত ঘসবার মসৃণ আওয়াজ। আর একটা মৃদু মিষ্টি গুনগুন। তারপর থামিয়ে তাহমিনা শুধালো গলা বের করে, তোমার ভয় করছে নাতো?
উঁহু।
ঠিক করে বল।
নাঃ। আর করলেই বা।
ফারুক বুঝতে পারল। দরজা ঠেলে সে ভেতরে ঢুকলো। তাহমিনা টাওয়েল দিয়ে সারা শরীর চট করে ঢেকে বলল, ছেলেমানুষের মত, উম্, না না, এসো না।
আমার ভয় করছে বাইরে।
মিথ্যেবাদী। দ্যাখো, দ্যাখো, পড়ে যাব যে।
তাহমিনার গায়ে পানি ঢেলে দিল ফারুক। হেসে উঠল ও। আর সেই হাসির সাথে সাথে বুক থেকে কয়েক ফোঁটা পানি ছিটিয়ে পড়ল। শুকনো একটা টাওয়েল নামিয়ে ফারুক ওর পিঠ ঘষতে লাগল জোরে জোরে।
না, না, মরে যাব। যাঃ লাগছে। ছাড়ো।
চুপ।
দুজনেই যেন ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। সব কিছু যেন ভুলে গেছে। শুধু এখনকার এই মুহূর্ত যেন সত্যি আর সব অবাস্তব। ঠাণ্ডা পানির স্পর্শে শীতল হয়ে এলো তাদের সমস্ত দেহ। সজীব হয়ে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালল। সবকিছু যেন ধুয়ে মুছে গেছে। ঝরঝরে আর হালকা লাগছে। বাতাসটা কী মিষ্টি! নতুন করে দুজনকে চিনল যেন এখন ওরা। ফারুক শুধালো টাওয়েল দিয়ে তাহমিনার দেহ মুছিয়ে দিতে দিতে, কেমন লাগছে মিনু?
এই তিন বছর বাদে ফারুক প্রথম ডাকল তাকে মিনু বলে। তাহমিনা ঘাড় ফিরিয়ে প্রায় ওর মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে প্রতিবাদ করল, দূর, আমাকে মিনু বলে ডেকো না।
কেন?
মনে হয় এখনও ছোট্ট রয়ে গেছি।
খুব বড় হয়েছ, না?
তাছাড়া কী?
একটুও না।
বলেই হেসে ফেলল ফারুক। হাসল তাহমিনা। তারপর হঠাৎ থামল। স্পর্শের ভাষায় কী কথা যেন সঞ্চারিত হয়ে গেল দুজনের ভেতরে। তারা তাকিয়ে রইল দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে নিতে। ফারুক ওকে জড়িয়ে ধরে গভীর চুমো আঁকল নতুন করে। তারপর আবার তাকিয়ে রইল পরস্পর।
এক হাতে আঁচল ঠিক করতে করতে অন্য হাতে বেডল্যাম্প নিয়ে বেরিয়ে এলো তাহমিনা। থামল। বলল, রাত অনেক হয়েছে। এবার শুতে যাও।
১২. দূর থেকে দেখেই খোকা দৌড়ে এলো
দূর থেকে দেখেই খোকা দৌড়ে এলো। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, এই, এই, আম্মা ডাকছে। তাহমিনা প্রায় হাঁটু গেড়ে বসে বলল, এই কিরে বাবু? এই কি? আপা বলতে পারিস না! দাঁড়াও তোমার আম্মার কাছে বলে দিচ্ছি।