কী?
আমাদের জীবনে আমরা কী চাই?
ফারুক একটু একটু করে প্রতিটি শব্দের ওপর জোর দিয়ে বলল, বিশ্বাস, শান্তি আর ঐশ্বর্য। আমিও তাই চেয়েছিলুম ফারুক। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার।
অনেকক্ষণ থেমে ফারুক শুধালো, আজ দুপুরের সে কথা কি সত্যি তাহমিনা?
হ্যাঁ। আবিদ আমাকে তা দিতে পারে না।
কী করে জানো?
তাহমিনা অদ্ভুত হেসে বলল, আমি জানি।
তাহমিনা—-
কি হবে আমার ঐশ্বর্য দিয়ে? কী লাভ
হঠাৎ তাহমিনার চিবুকে সেই ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল। সে থামল। যে কথা সে উচ্চারণ করেছিল তা কামরাময় ঘুরে বেড়াল। প্রতিধ্বনি হয়ে জেগে রইল। আর ফারুক জানতে পারল এখুনি সে বলবে——– সব কিছু বলবে তাকে। সে অপেক্ষা করে রইল।
প্রথম সন্দেহ হয়েছিল বছর দেড়েক আগে। তাহমিনা জিজ্ঞেস করেছিল আবিদকে। আবিদ হেসে উড়িয়ে দিয়েছে কথাটা। কিন্তু একবার যখন প্রশ্নটা উঠেছে, তখন সন্দেহ তার মনেও গম্ভীর হয়ে উঠল। তখন থেকেই শুরু। তাহমিনা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তারপর একদিন আবিদ চলে এসেছে ঢাকায়। সবচে বড় ডাক্তার দেখিয়েছে। রিপোর্ট তিনি লিখে দিলেন, ভালো হবার কোনো আশা নেই। আবিদ যখন ফিরে এলো তখন তার চেহারা দেখেই সব অনুমান করে নিতে পেরেছিল তাহমিনা। কিন্তু জিগ্যেস করলে আবিদ বলেছে, ওটা একটা সাময়িক ব্যাপার। ওষুধ দিয়েছে, কোনো ভয় নেই।
তুমি লুকোচ্ছ নাতো?
আবিদ জোর করে হাসি টেনে উত্তর করেছে, তোমার কাছে লুকোবো মিনু?
একদিন পরেই তাহমিনার কাছে সব উঘাটিত হয়ে গেল। একদিন আবিদের সেফ ড্রয়ার কী কারণে খুলেছিল। সেখানে রাখা ছিল সেই মেডিক্যাল রিপোর্ট। কিছুই সে করে নি। ভাঁজ করে ওটা আগের জায়গাতেই রেখে দিয়েছে। আবিদ সন্ধ্যের সময় এলে পর, তাহমিনার গম্ভীর মুখ দেখে শুধিয়েছে, কী হলো আবার তোমার?
তুমি আমার কাছ থেকে লুকোলে কেন?
আবিদ চিৎকার করে চেঁচিয়ে উঠল, সেফড্রয়ার খুললে কেন তুমি?
আমার অধিকার আছে বলেই। কেন তুমি লুকোতে গেলে?
সে কৈফিয়ৎ তোমাকে দিতে হবে নাকি?
হ্যাঁ।
না, তোমাকে দেব না।
চিৎকার করে কথাটি উচ্চারণ করে উন্মত্তের মত আবিদ তার সমুখে থেকে চলে গিয়েছে। তারপর থেকেই দুজনে অসম্ভব দূরে সরে গেল এক মুহূর্তে। এক বিছানায় শুয়েও যেন দুজন দু মহাদেশের অধিবাসী। আবিদ উন্মাদ হয়ে গেল তার বন্দুক নিয়ে। দিন রাত অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে তার ব্যর্থ পৌরুষত্বের শোধ নিতে লাগল। চোখের দৃষ্টিতে তার হিংসা। আর দিনে দিনে আতঙ্কিত হয়ে উঠল তাহমিনা। ব্যর্থ কান্নায় সে ডুবে গেল। সমস্ত ঐশ্বর্য তার কাছে তুচ্ছ।
সেদিন যখন আহত হয়ে আবিদ ফিরে এল জ্ঞানশূন্য অবস্থায়, তখন ভয়ে তার দম বন্ধ হয়ে এসেছে। সমস্ত বোধ তার লুপ্ত হয়ে গেছে। তাহমিনা প্রার্থনা করল মরে যাবার জন্যে। প্রার্থনা করল এই হিংস্রতা আর আঁধি দেয়ালের দেশ থেকে তার মুক্তির জন্যে। তখন যদি আবিদের মৃত্যুও হোত তার চোখের সমুখে, তবুও তার এতটুকু বিকার দেখা দিত না। ঘৃণায় ধিক্কারে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল তাহমিনা।
ফারুকের সোফার পাশেই ছিল রেডিও সেট। ব্যাটারি থেকে লাল আর নীল সরু তার উঠে এসেছে। তাহমিনা উত্তেজিত অথচ ফিসফিস স্বরে যখন বলে যাচ্ছিল এই ইতিহাস, তখন ফারুক চোখ নিচু করে রেডিওটার দিকে তাকিয়ে ছিল সারাক্ষণ। একসময়ে অন্ করে দিল সে। আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে দেখল সমস্ত স্টেশন। বিচিত্র দুর্বোধ্য স্বচ্ছ জল অভিঘাতের নিচু শব্দ উঠতে লাগল। তাহমিনা একটু থামল। তারপর বলল, সকালে ওকে সদরে রেখে আসবার পর কী করে যে সময় আমার কেটেছে, তা তোমাকে কী করে বোঝাই!
তারপর তুমি আমার কাছে লিখলে?
হা। তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে মুক্তি দিতে পারবে না ফারুক। তুমি আমাকে ঠেলে দিও না।
হঠাৎ সমস্ত ঘরে ছড়িয়ে পড়ল সুর মূচ্ছনা। মিহি তার ধ্বনি ভাসিয়ে দিল কামরার রুদ্ধ বাতাস। অলস গড়িয়ে গেল মেঝের ওপর। ফারুক ভলুম কমিয়ে দিল। শুধু অনুভব হয়ে রইল সেই সংগীত। রক্তের ভেতরে জাগলো এক রিমঝিম। ফারুক বলল, পলিনেশিয়ার মোআনা মেলডি বাজছে।
তাহমিনা একটুখন চুপ করে রইল। মৌতাতের মত জড়িয়ে ধরল তাকে সেই সংগীত। সে উচ্চারণ করল, তুমি কি বোঝো না?
আমি বুঝি তাহমিনা। কিন্তু আবিদ রয়েছে যে।
আমি ওকে আর ভয় করি না।
সে কী করে হয়?
তুমি কাপুরুষ।
তাহমিনার স্বর শোনাল সেই অর্কেস্ট্রার একটা মিষ্টি যন্ত্রের ধ্বনির মত।
আমাকে ভাবতে দাও।
আর কবে?
তবু।
না।
বলতে বলতে তাহমিনা শুভ্রশয্যায় এলিয়ে চোখ বুজলো। মেঝের লাল কার্পেট আগুনের মত জ্বলে উঠল ফারুকের চোখে।
পলিনেশিয়ার প্রবাল কি এমনি লাল? সেখানে সেই পাম আর রবার বনে আজ নীল জোছনা। সাদা শীটের মত সমুদ্র আর বালিয়াড়ি। সেখানে উদ্দাম নৃত্য ভঙ্গিমায় শৃঙ্গারের মুদ্রা আজ। কুরঙ্গের মত গতি সেই নর্তক আর নর্তকীদের। আর ইউকেলেলির বুক স্পর্শ করা ঝংকার। অ্যাকর্ডিয়নের একক ধ্বনি তরংগ। কখনো সেই সুরতরংগ অলস মন্থর হয়ে আসছে, তারপর পরমুহূর্তেই একরাশ উজ্জ্বল শুভ্রতার মত চূর্ণ চূর্ণ হয়ে বিক্ষিপ্ত ছিটিয়ে পড়ছে। রক্তের জোয়ারকে আহত করছে ক্রমাগত। পলিনেশিয়ার জোছনা কি নীল? তার বালুকা বেলা কি শুভ্র? তার রবার বনে স্বপ্ন মর্মর?
ফারুক সেই মূৰ্ছনায় ভেসে গেল। বিস্মৃত হলো। সে বলল, আমি আর ভাবি না তাহমিনা। তাহমিনা একটুও নড়ল না। তেমনি চোখ বুজে পড়ে রইল। কিছু বলল না। সে কি শুনতে পায়নি ফারুকের স্বর। আজ সে সব বলেছে, আর তার কোনো ভাবনা নেই। সে মুক্ত। সমস্ত ভার তুলে দিয়েছে ফারুকের কাছে। এই সুরতরংগ শুধু অনুভব করা যায়। এখানে শুধু নিমগ্ন হয়ে যাওয়া যায়। ধীরে ধীরে একটা সুর স্পষ্ট হয়ে রইল তার কাছে জড়িয়ে ধরল—- বুঝতে পারল তার নাম ফারুকের সান্নিধ্য।