এই ছোট্ট সংসারের কথা শুনতে শুনতে ফারুক ভাবল, তাহমিনা কি ভাবছে এখন? সে আড়চোখে তাকাল তার দিকে। গভীর আগ্রহ নিয়ে, যেন নতুন কোন গল্প শুনছে এমনি তন্ময়তায় সে শুনছে। আর তার উন্নত বুক ছোটখাট ফুলে উঠছে মৃদু নিঃশ্বাসের দোলায়। অবশেষে উঠবার সময় হোলো। আফিয়া বলল, তাহমিনা থাক। অনেকদিন আসেনি। আমরা দুজনে গল্প করি। আবদুল এসে নিয়ে যাবে। আর আপনি আর একবার আসবেন।
ফারুক এইখানে হেসে বলল, দেখি। তরপর বলল, আসব নিশ্চয়ই।
আশরাফ বলল, আপনি একটু দাঁড়ান। আমি ভেতর থেকে আসছি। এক সাথেই বেরোই। সবাই চলে গেলে ফারুক একেলা বসে রইল সেই কামরায়। শুধু মাত্র সে। এই মুহূর্তে সে অনুভব করতে পারল তার সত্ত্বাকে, তার পৌরুষত্বকে। সেই শঙ্কা যা সারা বিকেল তাকে ভর করে ছিল, এখন তা নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে গেল। অনুভব করল সাহসের স্বাদ। সে কিছুতেই তাহমিনাকে এমনি করে একটি নিষ্ফল আকাক্ষার মত মরে যেতে দেবে না। না—-তাকে সে মরতে দেবে না। আস্তে আস্তে এই সিদ্ধান্তের অনুরনণ যেন ছড়িয়ে পড়তে লাগল তার সারাটা শরীরে। তার চোখ স্থির নিবদ্ধ হলো মেঝের একটি বিন্দুতে। সে ভাবল। সে তাহমিনার কথা ভাবল। তাহমিনা কত বদলে গেছে তবু সে তার সেদিনের তাহমিনা। পার। হয়ে এসেছে তারা দীর্ঘ একটি সময়ের ব্যবধান তবু এই ব্যবধান—-আজ এক মুহূর্তে এমন কি অকারণে, এই কামরায়, বিলীন হয়ে গেল। অদ্ভুত এক ভাবনা তাকে মৃদু বিস্মিত করলো যেন সে এ কামরায় আজ নতুন আসেনি, বহু দিন বহু কাল ধরে আসছে, আবিষ্কার করেছে ঠিক এই কামরায় এই একই চেয়ারে ঠিক এমনি ভঙ্গিতে বসে মেঝেতে চোখ রেখে হৃদয়ের একেকটা উপলব্ধি, যেন জন্মান্তর থেকে এখানে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছে, আজো নিয়েছে। এমনি সহজ, এমনি ঋজু। কোনো অভাবনীয়তা নেই। কোনো। সংশয় নেই। একদিন সে তাকে ভালবাসতো। হঠাৎ সে আবিষ্কার করেছে আজো তাহমিনাকে সে ভালবাসে। আরো আপন করে, আত্মার মুখোমুখি তাকে সে ভালবাসে।
একটু পর আশরাফ এলো। ও চমকে উঠে দাঁড়াল দ্রুত পায়ে। শুধালো, আপনার জিনিস পত্র?
আগেই বোটে চলে গেছে।
ও।
আশরাফকে সে এগিয়ে দিয়ে এলো ঘাট অবধি। আস্তে আস্তে বোট ছেড়ে দিল। পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আশরাফ হাত নাড়ল। সেও প্রত্যুত্তরে হাত নাড়ল। বোটমাঝি গফুর হাত তুলে। সালাম করল তাকে।
ফারুক অবসাদের ভঙ্গিতে হাত নামালো। মুখ ফেরাল বাংলোর দিকে। আবদুল পেট্রোম্যাকস জ্বেলেছে। উজ্জ্বল আলো তার চোখে আসছে এখান থেকেই। প্রথম সন্ধ্যে। আকাশে দুএক টুকরো মেঘ। একটি বড় তারা। দুদিকে শাল আর সুন্দরী গাছ দূরে দেয়ালের মত সিধে ওপরে উঠে গেছে। আর তারি পাতা বিছানো পায়ে চলা ফিরতি পথ ধরল ও। রক্তের ভিতর অনুভব করল—- অরণ্যের এক অদ্ভুত রহস্যময় আকর্ষণ আছে। সে শুধু কাছে টানে। কাকে যেন টানে। জড়িয়ে ধরতে চায় অমোঘ অলস মৌতাতের মত। ইচ্ছে হয় এখানে এই ভিজে ছায়ায় শুয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে। অথবা হারিয়ে যেতে এই অরণ্যে। এখানে যারা আসে, তাদের কোনো দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই, বাধা নেই, সংকোচ নেই। কিছুই নেই। সমস্ত মুখোশ খুলে আদিম নগ্ন মানুষ হয়ে ওঠে তারা। ফারুকের রক্তের ভিতরে অণুতে অণুতে প্রবাহিত হয়ে গেল এই গান।
১১. পেট্রোম্যাক্স নিভে গেছে
পেট্রোম্যাক্স নিভে গেছে। এখন তাহমিনার ঘরে জ্বলছে রাত দশটার বেডল্যাম্প। নিঝঝুম হয়ে গেছে চারদিক। শুধু দূর দিগন্ত থেকে কিসের একটা একটানা ধ্বনি আর নদীর জল বয়ে যাবার ঝাঁপসা আওয়াজ। কোথাও কেউ নেই। তাহমিনার দীর্ঘ কামরার দূর কোণায়। বেডল্যাম্পের আলো ভালো করে পৌঁছায় নি। সেখানে প্রায় অন্ধকার। খাটের উপচ্ছায়া। ফারুক দূরে বসেছিল একটা মখমল ঢাকা সোফায়। খোলা জানালা দিয়ে অস্পষ্ট রাত্রি। ফারুক ঘরের দূরতম কোণে চোখ রেখে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করল, তুমি এ বিয়েতে সুখী নও তাহমিনা?
তার গলার স্বরে এত অবসাদ যে প্রশ্নটা প্রশ্ন বলে মনে হোলো না। স্বগত উক্তির মত শোনাল।
তাহমিনা বসেছিল খাটের ওপর। বাঁ হাতে হেলান দিয়ে। শুভ্র সুন্দর নিটোল বাহু তার এসে বিছিয়ে পড়েছে কোলের ওপর। মুখরেখা গড়ে উঠেছে মিহি আলোয়। এখন সে একবার মুখ তুলে তাকাল। উজ্জ্বল চোখ তার দেখাল কাঁচের বাটিতে রাখা স্বচ্ছ পানির মত। বলল, তোমাকে ঢাকা থেকে ডেকে এনেছি বলে তুমি অবাক হয়েছ, তাই না? ফারুক চুপ করে রইল।
কিন্তু তুমি জান না এই এক বছর আমি কী করে কাটিয়েছি। তোমার মনে আছে ফারুক? একবার বিয়ের আগে তোমায় বলেছিলাম এ হয়ত আমার আত্মহত্যা।
হ্যাঁ।
সে কথাই যে সত্যি হয়ে দাঁড়াবে, তা আমি ভাবিনি।
তুমি আশা করছিলে, তুমি সুখী হবে?
তাহমিনা যেন লজ্জিত হলো।
হ্যাঁ।
তোমার ভালোবাসা?
সেও সত্যি ছিল।
তাহলে?
আমি কিছুই বুঝতে পারি নি সেদিন।
আমিও পারি নি। তাহমিনা, তোমাকে আমি আজও ভালবাসি।
তাহমিনা কোনো কথা বলল না। ফারুক বলল, মনে পড়ে, তুমি একদিন বলেছিলে, ওকথা শোনাও তোমার পাপ?
ফারুকের দিকে চোখ তুলে তাকাল তাহমিনা। স্পষ্ট দেখতে পেল তাকে। বিরাট কামরার ভেতরে একটু ছোট দেখাচ্ছে ওকে। দূরে আয়নায় আরো ছোট হয়ে পড়েছে ওর প্রতিচ্ছবি। ফারুকের কপালে টলটল করছে কয়েক ফোঁটা ঘাম। শুকনো হয়ে গেছে ঠোঁটজোড়া। তাহমিনা জানে তার নিজের কথা। তার নাকের সমুখে এখন সঁচের চোখের মত ছোট ছোট ঘাম জমছে। আর কানের পেছনে। যে কোনো মুহূর্তে গড়িয়ে পড়তে পারে। সেই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করল তাহমিনা। কিন্তু পড়ল না। অবশেষে বলল, আজ স্বীকার করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই ফারুক। তারপর একটু থেমে বলল, একটা কথার জবাব দেবে?