তাহমিনা, আমি এমন হবে জানলে ওখানে যেতাম না। অজান্তে তোমাকে আঘাত দিইছি। আঘাত তোমাকে আমি দিতে চাইনি।
না, ফারুক না।
কী না, তাহমিনা?
তাহমিনা বালিশ থেকে তবুও মুখ ফেরাল না।
ফারুক অপেক্ষা করল আরো কিছুক্ষণ। কোন কথাই বলল না ও। শেষ অবধি একটু ইতস্তত করে বলল, তাহমিনা শোনো, আমি তারচে চলে যাই।
কেন ফারুক?
চলে যাওয়াই আমার ভালো। আমি যাই।
তাহমিনার সারাটা শরীর শুধু কান্নার অভিঘাতে কেঁপে উঠল আরো। মুখ ডুবিয়ে নিল বালিশের আরো গভীরে। ফারুক কি করবে কিছুই ভেবে পেল না। তাহমিনা জোরে জোরে দুবার শ্বাস নিল। আর সে ভয় পেয়ে কাছে এসে তার পিঠের ওপর আলতো হাত রেখে শঙ্কিত গলায় শুধালো, কি হলো তোমার তাহমিনা?—-তাহমিনা!
আমার কোন দোষ নেই, আমি কোনোদিন মা হতে পারব না ফারুক। বালিশের ভেতর। থেকে এই অস্পষ্ট উচ্চারিত বিজড়িত কথাটি তীক্ষ্ণ হয়ে এসে বিধল ফারুককে। সে চমকে উঠল। একি বলছে তাহমিনা? সে কি উন্মাদ হয়ে গেছে? নিজের কানকে সে যেন বিশ্বাস করতে পারল না? পাথরের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
আর তাহমিনাও যেন বিশ্বাস করতে পারল না নিজের কানকে। যে কথা সে আজ এক বছর হোলো টের পেয়েছে, যে কথা সে বলবার জন্য ফারুককে কাছে চেয়েছে, যে কথা কাল। ফারুক আসা অবধি তাকে মৃদু অবিরাম আগুনে পুড়িয়েছে তা সে উচ্চারণ করেছে। এই প্রথম উচ্চারণ করেছে। আর তার দ্বিধার অবকাশ নেই। আর তার ফেরবার পথ নেই। তাই নিমেষে তার কান্না আর ফোঁপানো থেমে গেল। স্থির হয়ে তেমনি উবু হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে নিস্পন্দ পড়ে রইল।
ফারুকের চোখে পড়ল নিমেষের এই পরিবর্তন। গোটা পৃথিবী ধোঁয়ায় ধূসর অস্বচ্ছ অবাস্তব হয়ে এল তার সমুখে। সমস্ত বোধ তার শিথিল হয়ে গেল। আস্তে আস্তে তার কাছে স্পষ্ট হয়ে এল তাহমিনার চিঠি লেখা থেকে এই মুহর্ত অবধি প্রতিটি ব্যবহার, প্রতিটি কথার অর্থ। টুকরো টুকরো ঘটনা যা অসংলগ্ন বলে একটু সময় আগেই মনে হয়েছিল, এখন তার সূত্র সে যেন উদ্ধার করতে পারল। বিদ্যুতের মত কাল থেকে আজ অবধি তাহমিনার প্রতিটি মুখ ভেসে উঠল। তার মনে হোলো ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে সে পারবে না। তার ভীষণ ভয় করলো। সে একটু পর পালিয়ে এলো নিজের কামরায়।
১০. বিকেল যখন হয়ে এলো
বিকেল যখন হয়ে এলো তখন শুয়ে থেকে তাহমিনা ভাবল, আশরাফ বলে গেছে যেতে না গেলে ভালো দেখাবে না। তাছাড়া আজ দুপুরের ঘটনাটা যদি তার কানে যায় আর সে না যায় চায়ে, তাহলে দুয়ে মিলে একটা কিছু হতে পারে। তা হতে দেবে না তাহমিনা। আর সে না গেলে ফারুক যে একেলা যাবে, তারই বা কী মানে আছে?
অবশেষে বিছানা ছেড়ে উঠে—- তারপর এই প্রথম উঠল—- বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো ভালো করে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছল রগড়ে। প্রসাধন করল। পরল ফিকে সবুজ জমিনের ওপর পাড় দেয়া শাড়ি আর সাদা সার্টিনের ব্লাউস। আবদুলকে ডেকে বলল, ফারুককে তৈরি হয়ে বেরুবার জন্যে খবর দিতে। না, সে সঙ্কোচ করবে না।
দুজনের দেখা হোলো। কথা বলল না। চুপচাপ নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে তারা। হাঁটতে লাগল। পথের দুপাশে বেতের কচি সবুজ পাতা। ইতস্তত শাল আর সুন্দরী। এদিকে বন। ঘন নয়। এদিকে মানুষের বসতি আছে। সব কেমন যেন চুপ এই মুহূর্তে। গাছের পাতাও নড়ে না। পাখিও ডাকে না। যে বনে পাতা পড়ে কুলো হয় সেখান থেকে কোনো আওয়াজও আসে না। সমস্ত এলাকাটা শুধু স্তব্ধ। দুএকটা বসত বাড়ির উঠোন কী অসম্ভব রকম তকতকে, ঠাণ্ডা আর নিঃশব্দ। দুজনেই যেন বধির হয়ে গেছে এমনি চুপচাপ, তাদের যেন আর কিছু ভাবার নেই এমনি নিশ্চিন্ততায় পরস্পর হেঁটে চলল।
ফারুকের মনে এখন নেই আতঙ্কের স্বাদ, নেই ভীত অনুভূতি। তাহমিনার ভাবনা এখন খর নদীর স্রোতের মতন।
দুজনের স্তব্ধতা এখন মুখোমুখি।
তারা এসে পৌঁছুলো। আশরাফ তখন তৈরি হয়ে নিয়েছে, ওদের সাথে চা খেয়ে একসাথে বেরুবে। ওরা বাংলোয় যাবে। আর সে বোটে করে ছনম্বর প্লটে। আশরাফ দূর থেকে দেখেই এগিয়ে এল। বলল, আসুন, আসুন। এসো, তাহমিনা। খোকা, তোর আম্মাকে খবর দিয়ে আয় তো।
ওরা যখন গিয়ে বসলো বসবার ঘরে, তখন তফিয়া এলো। অত্যন্ত কম আসবাবে সাজানো প্রসস্ত কামরা। নিচু আর গভীর বসবার আসন। একধারে আলমিরায় কিছু বই। দেয়ালে একটা চিতল হরিণের ছাল ঝুলিয়ে রাখা। ফারুক আর তাহমিনা সেদিকে তাকাল, নামিয়ে নিল দুজনেই দৃষ্টি। তারপর ফারুক চোখ ফেরালো আফিয়ার দিকে। ভারী, গোলগাল, স্নেহময়ী মানুষটি। গালের গভার ট্রোল আর ঠোঁটের নিঃশব্দ হাসি লেগেই আছে। উজ্জ্বল ফর্সা রংয়ের সাথে চাপা রংয়ের শাড়িটি মানিয়েছে অপূর্ব। পান খেয়েছেন কখন, এখনও ঠোঁটজোড়া স্বচ্ছ লাল হয়ে আছে। দেখলে শ্রদ্ধা হয়, দুদণ্ড বসতে ইচ্ছে করে। আফিয়া তাহমিনাকে শুধালো উদ্বিগ্নস্বরে, কী হয়েছে তোমার বলো তো?
কই, কেন, কিছু নাতো।
কিন্তু মুখ কেমন ভারী দেখাচ্ছে দেখছি।
ফারুক অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। তাহমিনা উত্তর করল, দুপুরে শুয়ে শুয়ে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি তাই।
ও।
কিছুটা শঙ্কিত স্বরে আফিয়া অনুমোদন করলো।
তারপরেই সহজ হয়ে এলো আবহাওয়া। বিকেলের চায়ের নামে আফিয়া যা করেছে তাকে ফারুক আর বিকেলের চা বলতে সাহস পেল না। হাতে তৈরি তিন রকম মিষ্টি থেকে শুরু করে, পরোটা, কিছুটা ঝাল আর নিখুঁত করে বানানো চা। বসে বসেই ফারুক শুনলো ওদের সংসারের গল্প। বড় দুছেলে চাটগাঁয়ে আছে। বোর্ডিং থেকে পড়ছে। আশরাফ চায় না ওরা এই বুনো ব্যবসা ধরুক। তারপর এক মেয়ে ছিল, সে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। সে কথা বলতে গিয়ে আফিয়ার চোখ কিছুটা ভিজে উঠলো আজো। দেয়ালে সেই মৃতা কন্যার ছবি। কিশোরী তনুতে সে সখ করে পরেছে বার্মিজ দেহাভরণ। আর তাইতে লাজুক দেখাচ্ছে আরো। তারপরে এই ছেলে। ওদের সাথেই এখনো আছে। আফিয়া দুবেলা পড়ায়। বড় হলে তাকেও পাঠিয়ে দেবে চাটগা কী ঢাকায়।