কিন্তু কী আবদুল? উনি কিছু বলবেন না। আমি বলে দেব।
আচ্ছা আমি নিয়ে আসছি।
কিছুক্ষণ পরে আব্দুল এসে বলল, আসুন। ও ঘরের আরেকটা চাবি আমার কাছেই থাকে। যেন এক রহস্যের রাজ্যে যাচ্ছে, একটু সাড়া পেলেই সব মিলিয়ে যাবে শূন্য বাতাসে; যেন এক অরণ্য–হরিণের শিকারে যাচ্ছে সে, একটু শব্দ উঠলেই সেই ঘাইমৃগী পালিয়ে যাবে এমনি সাবধানে, সন্তর্পণে পা ফেলল ফারুক। আব্দুল পাশে পাশে ফিসফিস করে বলল, সায়েব আমাদের এ এলাকার সবচে নামজাদা শিকারী। একটা টিপও ফসকাতে পারে না ওঁর হাত থেকে, এমনি। আর সে কী শিকারের নেশা। দিন নেই রাত নেই শুধু বনে বনে শিকার আর শিকার।
ফারুক একবার দাঁড়িয়ে কান পাতল তাহমিনা জেগে উঠেছে নাকি। না। সে এবার শুধালো, শুনেছি, আগে নাকি এরকম ছিল না।
হ্যাঁ হুজুর। এই অল্পদিন হলো মাত্র প্রায় এক বছর হবে। এর আগেও যেতেন, খুব কম। তখন বাঘও মেরেছেন। কিন্তু এ বছর চোখে যা পড়েছে, তা আর নিস্তার পায় নি। আসুন। ফারুকের চোখের সামনে অদেখা এক রাজ্যের তোরণ যেন খুলে গেল। মাথার ওপরে স্কাইলাইট। অনেক ওপরে। লাল আর নীল কাঁচের বর্ণালী ছায়া এসে পড়েছে চারদিকে। কখনো কখনো সম্পাত হয়ে সৃষ্টি করেছে বেগুনি আভা। সাঁঝের রঙে যেন ভরে গেছে সমস্ত কামরা। ধূসর আর ম্লান। অদ্ভুত ঠাণ্ডা। বাইরের ঝলসানো রোদের পাশে অবিশ্বাস্য রকমে শীতল। একধারে দীর্ঘ পরিচ্ছন্ন এবং বার্নিশ করা আলমিরায় কয়েকটা বন্দুক খাড়া করে রাখা। ঝকঝক করছে। নীল নীল একটা দ্যুতি বেরুচ্ছে। ইস্পাত কী ঠাণ্ডা। আর ঘরের মাঝখানে বিরাট টেবলের ওপর কার্টিজ শূন্য স্ট্রাম্প পড়ে রয়েছে। কেউ হয়ত ছুঁড়ে ফেলে গেছে। আর তুলে রাখা হয়নি। দেয়ালের নিচু চারটে প্রশস্ত র্যাকে রাখা চারটে কুমির। ভেতরে খড় পোরা। মেঘের মত ঘোলা উদাস চোখ তাদের। আর মাথার ওপরে বুনো মোষের মাথা। টনি রঙের পশমওলা। এখুনি হয়ত শিং নেড়ে অন্ধের মত তেড়ে আসবে। ফারুক সম্মোহিত তাকিয়ে রইল। বাঘের পুরু সোনালি ছালটা কী কোমল! ব্যাবিলনের কোনো রাণীর ঘাড়ের ওপরে উজ্জ্বল এমনি চিতার ছাল বুঝি জড়ানো থাকতো শুভ্র মসৃণ পিঠ অবধি। একদিন আবিদের গুলি খেয়ে লাফিয়ে উঠেছিল আকাশে আক্রোশে, ধনুকের ছিলা ভাঙা মুদ্রায়। তারপর পাকা ফলের মত ঝুপ করে পড়ে গেছে নিঃসাড় হয়ে। মাথার ওপরে খানিকটা গুলির ছেঁড়া চিহ্ন। মাথাটা নিচের দিকে ঝুলছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন মুখ লুকিয়ে হাসছে অরণ্যের সম্রাট।
ফারুকের সারাটা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। আবদুল কী যেন বলছে, হয়ত শিকারের ইতিহাস বলছে, ভালো করে কানে আসছে না তার। যেন প্রতিহত হয়ে ফিরে যাচ্ছে। যেন সে রূপোর কাঠিতে ঘুমিয়ে পড়া এক হিংস্রতার নীল দেশে দাঁড়িয়ে।
আলমিরার পাল্লা খুলে ধরল আবদুল। একটু শব্দ উঠল তীক্ষ্ণ। একটা নখ তুলে ধরল সে। বেড়ালের চোখের মত রঙ তার। ভারী অথচ তীক্ষ্ণ। বাঘের নখ হুজুর।
কিন্তু ফারুক অবচেতন মনে অনুসন্ধান করে চলেছে আরো কিছু। সে উদঘাটন করতে চায় সেই রহস্য, যার জন্য তাহমিনা তাকে এ ঘরে আনে নি। বোবা সে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। আবদুল ওটা রেখে দিয়ে এবারে কুমিরের একজোড়া দাঁত তুলে নিল হাতে। আর এমন সময়ে, ঠিক এমন সময় আর্ত, ভীত, মিহি, দুর্বোধ্য চিৎকার শোনা গেল তাহমিনার, আবদুল! ঘুমে সারামুখ থমথমে ভারী হয়ে গেছে তার। কপালের ওপর সেঁটে রয়েছে একগুচ্ছ চুল। আলুথালু শাড়িতে দুপুর ঘুমের ভাঁজ। মুহূর্তকাল তীব্র স্তব্ধ হয়ে রইল তাহমিনা। তারপর ফেটে পড়ল, হাঁপাতে হাঁপাতে উচ্চারণ করল, কোত্থেকে চাবি নিয়েছ? কে তোমাকে বলেছে? বেরিয়ে যাও ঘর থেকে বেরিয়ে যাও বলছি আবদুল।
আবদুলের সারা শরীর কেঁপে উঠল। ধরাগলায় একবার মাথা নিচু করে বলল, মেমসাব।
কোন কথা শুনব না, বেরিয়ে যাও।
আবদুল বেরিয়ে গেল। তাহমিনা এসে দাঁড়াল ফারুকের সমুখে। তাহমিনার চোখে ভয়াবহ শূন্যতা। সে পাগলের মত, ভূতগ্রস্তের মত, বলে চলল, কে তোমাকে এখানে আসতে বলেছে? কী দেখতে এসেছো? বল, বল।
ফারুক চুপ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল বিহ্বল হয়ে। তাহমিনা কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে? এমন করছে কেন? সে দুহাতে ওর বাহু মূল ধরে ঝাঁকি দিয়ে ডাকল চাপা স্বরে, তাহমিনা, তাহমিনা।
হাত সরিয়ে নিল ও।
চলে যাও এ কামরা থেকে।
কিন্তু গেল না সে। একটু থামল তাহমিনা। তারপর নিমেষে কী যে হয়ে গেল তা ফারুক বুঝতে পারল না। তাহমিনা দুহাতে আলমিরার সমস্ত নখ আর দাঁত ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে। বাঘের সেই উজ্জ্বল ছাল ধরে টান দিল! একটু নড়ে স্থির হয়ে গেল ওটা। তারপর কর্ড ছিঁড়ে মঝের ওপর ভাঁজ হয়ে লুটিয়ে পড়ল। আর তাহমিনা বলে চলেছে—- দ্যাখো, দ্যাখো, এইসব দেখতে এসেছ। দ্যাখো, দ্যাখো তুমি।
ফারুক এবার তাকে আঁকড়ে ধরল। উচ্চারণ করল একবার তার নাম। একটু পরে সহসা শান্ত হয়ে এলো তাহমিনা। বুঝতে পারল সে কি করছে। ফারুকের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিজের বিছানার ওপর গিয়ে লুটিয়ে পড়ে ছেলেমানুষের মত কাঁদতে লাগল। ছোট ছোট তরংগের মত দেই তার কেঁপে উঠল। সে অনুভব করতে পারল ফারুক এসে দাঁড়িয়েছে কামরায়। ঠিক তার পাশেই। মুখ লুকিয়ে রেখেই কান্নাগলায় বলল, আমি কী করব ফারুক? আমার এ–কী হোলো? কেন আমার এমন হোলো? কেন? কেন?