কেন?
তাহমিনার মুখ থেকে হঠাৎ প্রশ্নটা গড়িয়ে পড়ল। আশরাফ তার দিকে তাকাল, অবশ্যি তুমি যদি দরকার মনে না কর, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। এমনি বলছিলাম।
তাহমিনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তাহলে আশরাফ ওরকম কিছু ভেবে বলেনি। আশরাফ উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘুরে বলল, ভালো কথা, বোট আমি নিয়ে যাচ্ছি। তোমার যদি সদরে যেতে হয়?
সে ব্যবস্থা হবে একটা।
আচ্ছা। কোনো খবর পেলে দেরি করো না, সদরে যেও। কী থেকে কী হয় বলা যায় না। অবিশ্যি আমার যদুর মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। আর ভয়েরই বা কী। তুমি ভেবো না ওসব।
তাহমিনা ম্লান হাসল শুধু প্রত্যুত্তরে।
আশরাফের পেছনে পেছনে তাহমিনা এলো বাইরের বারান্দায়।
আশরাফ সমুখে আসতে আসতে বলল, আসুন ফারুক সাহেব, বেরুবেন বলছিলেন।
হ্যাঁ চলুন। কথা হলো?
হ্যাঁ। আজ বিকেলেই কাজে চলে যাচ্ছি—- এই সন্ধ্যেয়—- ফিরব কদিন পর।
ও।
থেকে যান না কদিন। আমি ঘুরে আসি। ও–ও ভালো হয়ে আসুক। সারা সুন্দরবন আপনাকে চিনিয়ে দিতাম। তাহমিনার দিকে ফিরে বলল, বলো না ওকে থেকে যেতে।
ফারুক তাহমিনার দিকে আধো চেয়ে উত্তর করলো, পারলে থাকতাম বৈকি। আবার আসব।
আশরাফ এবার বলল, তাহলে দুপুরে আমার ওখানেই খাবেন আজকে।
শুধু শুধু আপনি আমাকে টানছেন। তারচেয়ে চলুন। ফারুক সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল।
আশরাফ বলল, কি বল তাহমিনা?
তাহমিনা প্রায় কিছুই বলল না এর উত্তরে। ফারুক ঠিক রাজি হতে পারল না। অবশেষে বিকেলে চা খাবে এই ঠিক হলো। আশরাফ শেষে বলে গেল, তুমিও এসো তাহমিনা। একসাথেই এসো।
আচ্ছা। আসব। ফারুক, দেরি করো না কিন্তু। কাল রাতে কিছু খাও নি।
এই তো এখুনি এসে যাবে।
আশরাফ ফারুকের হয়ে উত্তরটি দিল।
.
বাংলোর আশেপাশে কাছাকাছি ঘুরে বেড়াল ওরা। মাঝে মাঝে দুএক ঘর বসত। তার পরেই আবার অরণ্য। এর ভেতর দিয়েই মানুষ তার পায়ে চলার পথ করে নিয়েছে। আশরাফ গাছ চিনিয়ে দিচ্ছিল। বলছিল কী করে তা কাটা হয়, চালান হয়। হাঁটতে হাঁটতেই তার কাছে সে শুনলো সব কিছু। আঠারো বছর আগে কী করে আশরাফ আবিদের বাবার ফার্মে ঢোকে, সে গল্পও করল। এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে বেলা হলো বেশ কিছুটা। ফারুক ফিরে এলো। তাহমিনা বলল, দেখলে?
দেখলাম।
নাও এবার গায়ে পানি দিয়ে এসো। গরম করে দিইছি, নইলে নতুন পানি, গায়ে বসে যাবে। পায়ে শ্লিপার গলিয়ে ফারুক একটু হেসে, একটু থেমে, বলল, স্বাস্থ্য বলে যে একটা কিছু আছে আজ তা মনে পড়ল। তুমি না থাকলে তো ঠাণ্ডা পানিই গায়ে দিতাম।
এই করেই তো শরীরটা নষ্ট করলে।
কেন, খুব ভেঙে গেছে নাকি?
কই, না একটু।
তাহমিনা চলে যেতে যেতে বলল। তারপর নিজেই অবাক হলো, ও কথা বলতে গেল কেন? তিন বছরে ফারুক আরো সুন্দর হয়েছে, আরো দৃপ্ত হয়েছে। কিন্তু সে কথা কি বলা যায়?
ফারুক কী ভাববে?
খেতে বসে ফারুক বলল, এই বুনো জায়গায় এ সব যোগাড় করলে কোত্থেকে বল তো?
কেন, আমরা কি লতাপাতাই খেয়ে থাকি মনে করেছ?
না, তা কেন? আশা করিনি।
তুমি তো রান্নাঘরে যাওনি। গেলে দেখতে ঢাকার যে কোনো বড় হোটেলের সাথে পাল্লা দেয়া যেতে পারে।
আশ্চর্য!
ওই চপটা নিও। ফেলে রেখো না।
তাহমিনা সমুখে প্লেট এগিয়ে দেয়। একটু পরে বলে, দুপুরে ঘুমুবে তো?
কেন?
শুধাচ্ছি। বিকেলে আবার ওদের চায়ে যেতে হবে না?
না– দুপুরে ঘুমোনার অভ্যেস নেই। খবর কাগজের লোক আমরা, আমাদের ঘুমের কি আর টাইম বেটাইম আছে?
তাহমিনা ওর মুখের দিকে একবার চোখ তুলে পিরিচের ওপর নামিয়ে নিল। ফারুক তাকে একটু খুশি করবার জন্যেই যেন বলল, তাহোক, ঘুমিয়ে পড়লে ডেকে দিও তাড়াতাড়ি।
আচ্ছা।
আবদুল গ্লাশে স্বচ্ছ ঠান্ডা পানি জাগ থেকে ঢেলে দিল। হাত ধোবার গরম পানি এগিয়ে রাখল সমুখে।
.
বেলা প্রায় দুটো এখন। চারদিক স্তব্ধ। কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই। শুধু দূর–সবুজ রোদে পুড়ে যাচ্ছে। হলুদ শীটের মত রোদ এসে ছড়িয়ে পড়েছে যদুর দেখা যায়। ফারুক বিছানায় শুয়ে ছিল। তন্দ্রা নামছে তার চোখের ভিতরে। এই অরণ্যের সবুজের আঘ্রাণ যেন সে নিতে পারে, এত সূক্ষ্ম এখন তার অনুভূতি। আকাশ পাতাল সে ভাবতে লাগল আধো তন্দ্রার ভিতরে। এমন সময় পায়ের শব্দ। মুখ ফিরিয়ে সে শুধালো, কে, আবদুল?
জি হুজুর, ঘুরে যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে। কিছু বলবেন?
আবদুল দোরপর্দার ওধারে এসে দাঁড়িয়ে শুধালো।
এক গ্লাশ পানি।
গ্লাশে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফারুক বলল, লেবু কেটে দিয়েছ পানিতে না? তোমার মেম সায়েব কী করছে?
ঘুমুচ্ছেন।
ও।
আচ্ছা আবদুল—-ফারুক আধো উঠে বসলো, তোমার সায়েবের শিকার ঘর কোন দিকে জানো?
কেন? ডানহাতে পেছনের প্রথম ঘরের পরেরটাই তো। আপনি দেখেন নি?
না। আমাকে দেখাতে পারো?
খুব।
মেম সায়েবকে বলে দরকার নেই। ঘুমুচ্ছে। চুপ করে চাবি নিয়ে আসতে পারবে? বকশিস দেব।
আবদুল একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ফারুক মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে দেখবেই কি আছে। ওই কামরায়, যাকে তাহমিনার এত ভয়?—- যার জন্যে সে মিছে অবধি বলেছে, চাবি নেই? ফারুকের বিশ্বাস হয় নি। আবদুলকে চুপ করে থাকতে দেখে সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ও ঘর তুমি কোনোদিন খোলো নি?
খুলেছি হুজুর।
চাবি কোথায় জানো না?
জানি।
তাহলে ভাবছ কেন? আমি শুধু দেখব বৈতো নয়? যাও। ফারুক নিচু গলায় প্রায় তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল। তারপর শ্লিপিং শার্টের বোতাম ধরে অপেক্ষা করল উত্তরের। কিন্তু