আগাগোড়া বাংলোর বার দিকটা বটল গ্রীন রংয়ে পেন্ট করা। ভেতরে ক্রীম। তাহমিনা প্রায় সবকটা কামরাই দেখাল। টুকরো টুকরো মন্তব্য করল মাঝে মাঝে ফারুক। তারপর পেছনের বারান্দায় দাঁড়াল ওরা একটুখন। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে রান্নাঘরে কয়েকজন বাবুর্চি রান্না করছে। আবদুল মাঝে মাঝে গিয়ে তদারক করছে তাদের। সবশুদ্ধ বুঝি প্রায় পাঁচ ছজন হবে। ফারুক তাহমিনার দিকে তাকাল আশেপাশের সবুজ আর রৌদ্র থেকে চোখ ফিরিয়ে। বলল, এত উঁচু উঁচু সব থামের ওপর বাংলোটা। বেশ লাগে।
শুধু বেশ লাগার জন্যে নয়। দরকারও। বরষার দিনে নদী বাড়লে তখন পানি প্রায় এদিকটায় এসে পড়ে। তাছাড়া জংলা জায়গা।
বাঘ থাকে বুঝি এদিকে? সাপ?
থাকে, থাকে বৈকি? ওসব কথা বোলো না। আমার ভয় করে বড্ড।
দিনের বেলাতেও?
তবু।
আমি তো আছি। বন্দুক চালাতে জানি, ভরসা রেখো।
তাহমিনা তখন একটা কামরা খুলে বলল, আব এইটে আবিদের বসবার ঘর।
ওইটে বুঝি ওর ছবি?
দেয়ালে একটা বাঁধানো ফটোর দিকে তাকিয়ে ফারুক শুধালো।
হ্যাঁ।
ঢাকায় একবার দেখেছিলুম। অদ্ভুত তীক্ষ্ণ চেহারা।
তাই নাকি?
হাসলো তাহমিনা। জানালা খুলে দিল। সে হাসির বাকা ধ্বনি স্পর্শ করে গেল ফারুককে। সারাটা সকাল এমনি করে ঘুরে ঘুরেই কাটল। সমস্ত বাংলো দেখাল তাহমিনা তাকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল তারা ঘাট অবধি। ফিরে এসে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে তাহমিনা বলল, তুমি বোসো, বাইরে ডেকচেয়ার পেতে দিচ্ছি। আমি আর এক পট চা বলি তোমার জন্যে। না থাক। শোনো
কী?
একটা জিনিস তুমি আমাকে দেখালে না কিন্তু।
কী ফারুক।
তাহমিনা ওর দিকে তাকাল। যেন চোখের তেরে কিছু আবিষ্কার করতে চাইল।
আবিদের শিকারের কিউরিও। তাহমিনা হঠাৎ চমকে উঠে, শঙ্কিত গলায় বলল, কে তোমাকে বলেছে?
আবদুল—আবদুল বলেছে।
না, সে চাবি আমার কাছে নেই। না, নেই।
সে চলে গেল। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারল ফারুক, চাবি তাহমিনার কাছেই আছে। তাহমিনা দেখাতে চায় না বুঝি কামরাটা। কিন্তু কেন? কি আছে ওখানে? কেন, ও এমন করল? অনেকক্ষণ কেটে গেল। তবু তাহমিনা ফিরল না।
আবদুল ডেক চেয়ার পেতে দিয়ে গেছে বাইরের বারান্দায়। ফারুক সেখানে বসে তাকিয়ে রইল দূরে।
০৯. আশরাফ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে
আশরাফ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, আরো সকালে আসা উচিত ছিল আমার। দেরি হয়ে গেলো।
সে–কী। আসুন।
আশরাফ নিজেই ভেতর থেকে আরেকটা চেয়ার টেনে নিয়ে এসে পাশে বসলো। বলল, কেমন লাগছে এই এলাকা?
খুব ভালো।
আপনারা শহুরে মানুষ তাই। আমাদের চোখে এর সব বিউটি মরে গেছে। উপমা দিলে বলতে হয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এর সব দেখেছি আর কোনো গোপন রহস্য নেই।
বলেই উচ্চকণ্ঠে হাসল আশরাফ।
যাকগে সেসব কথা। আঠারো বছর বনে বনে ঘুরে খাস বুনো হয়ে গেছি। আপনাদের এখনো ভালো লাগবে।
ভালো আমার লেগেছে। সকালে ঘাট অবধি গিছলুম।
ও তাই নাকি?
ও দিকে ঘুরে দেখবার ইচ্ছে আছে।
বেশ তো, চলুন না। দাঁড়ান, তার আগে তাহমিনার সঙ্গে দুটো কথা বলে আসি। কী যে বিপদ হয়েছে আমার!
কী রকম?
এই ফার্ম নিয়ে। আপনি বসুন, আমি চট করে আসছি।
আচ্ছা।
আশরাফ চলে গেলে পর ফারুক আবার ডুবলো তার ভাবনায়। কাল নিস্তব্ধ গভীর রাতের সেই ঘটনার কথা সে ভাবল। একই ছবিকে বারবার ঘুরিয়ে দেখতে লাগল নানান কোণ থেকে। আশরাফ শোবার ঘরের দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকল, তাহমিনা।
বিছানার ওপর উবু হয়ে শুয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল তাহমিনা। হাতে ছিল বই, কিন্তু চোখ ছিল না সেদিকে। ডাক শুনে তাড়াতাড়ি উঠে বসল। বুকের ওপর শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল, আপনি!
হ্যাঁ, কথা ছিল। তোমার সময় হবে?
তাহমিনা দোরপর্দা সরিয়ে ডাকল, ভেতরে আসুন।
না ঠিক বসব না।
বলতে বলতে আশরাফ ঘরের কার্পেট মাড়িয়ে একটা নিচু চেয়ারে এসে বসলো। তাহমিনা কাছে এসে শুধালো, কি বলবেন?
কাল রাতে সেই যে নতুন অর্ডার কটার কথা বলেছিলাম—-
হ্যাঁ।
বেশ বড় অর্ডার সব কটাই
তাহমিনা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল।
ছ নম্বর প্লট থেকে সাপ্লাই দিতে হবে। সেখানে আমার যাওয়া দরকার। নইলে কাজ হবে না।
তাহমিনা দূরে একটা চেয়ারে বসে বলল, বেশ তো।
তুমি বলছ যাব?
কেন যাবেন না, যা ভাল হয় তাই করবেন।
কিন্তু এদিকে সব একেলা ফেলে? আবিদও হাসপাতালে, ওরই বা কী হয়, সেও একটা ভাবনা। তোমাকে এ সময়ে রেখে যাই কী করে তাই ভাবছি।
আপনি যান, আমার জন্যে ভাববেন না। কবে যাবেন?
গেলে আজকেই। সন্ধ্যেয় বেরুলে কাল প্রায় ভোরে গিয়ে পৌঁছুবো।
আপনি তাই করুন।
কিন্তু বেশ কয়েকদিন দেরি হবে যে।
হোক না। আপনি যান। আবদুল ওরা তো রইল।
বলতে গিয়ে তাহমিনার স্বর একটু কাঁপল। কিন্তু সে অতি সামান্য। আশরাফ বুঝতে পারল না ঠিক। বলল, উনি কতদিন আছেন?
কে? ফারুক?
হ্যাঁ।
তাহমিনা চমকে উঠল। ও কথা শুধালো কেন আশরাফ? না কি সব কিছু জেনে গেছে, তাকে সন্দেহ করছে? তাহমিনা আড়চোখে মুহূর্তের জন্য তাকালে তার দিকে।
কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। দ্রুত কোলের ওপর চোখ নামিয়ে সে বলল, চলে যাবে শীগগীরই। দুএকদিনের মধ্যেই। একটু থেমে বলল, দুর্ঘটনার কথা শুনে অবধি থাকতে চাইছে না।
ও।
আশরাফ যেন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল এইটুকু কথা বলে। কিছুটা চিন্তিত দেখাল ওকে। শেষে বলল, এক কাজ করো না, আফিয়া এসে কটা দিন থাক এখানে। তুমিও একেলা হবে না তাহলে, কী বল?