তাহমিনা।
বলো। স্বর তার কেঁপে গেল।
আমি কিছুই বঝুতে পারছি নে।
তাহমিনা আয়ত গভীর চোখ মেলে তাকাল তার দিকে। ফারুক হঠাৎ তার কথার খেই হারিয়ে ফেলল যেন। এবারে বলল, ফিসফিস করে, আশরাফের কাছে আমার মিথ্যে পরিচয় দিলে কেন? যদি ও জানতে পারে, যদি আবিদ জানে, তাহলে কী হবে? তোমার কী হবে?
তুমি চলে যেতে চাও? তাহলে এলে কেন?
ফারুক হঠাৎ চুপ করে গেল একথায়। মাথা নিচু করল।
আমি ক্লান্ত। তোমার ঘর ঠিক করে দিয়েছি। আবদুল বিছানা করে রেখেছে। আমি যাই। তাহমিনা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে চলে গেল। তার পায়ের নরোম শব্দ মিলিয়ে গেল একটু পরে। আবদুল এসে হারিকেনটা হাতে নিয়ে বলল, আসুন।
হ্যাঁ, চল।
পাশের কামরাতেই শোবার ব্যবস্থা হয়েছে তার। অনেকটা লম্বা আর কম প্রশস্ত কামরা। একধারে পাতা নিচু পালং। পুরু তোষকের ওপর নীল বর্ডার দেয়া ধবধবে চাদর পাতা। অনেক বড় দুটো বালিশ সাদা চিকন লেস আঁকা। ঠিক যেমন ভালোবাসে ফারুক। আর এ ধারে দেয়ালে ঝোলানো জলরংয়ের ল্যান্ডস্কেপ। বাঁ হাতে দৈর্ঘ্যের দিকে দুটো জানালা। ছবির ফ্রেমের মত দেখতে। শার্সির ওপরে একটু বাতাসে কাঁপছে সিলভার সবুজ পর্দা। ফারুক অবসাদে এলিয়ে দিল তার সারা শরীর। আবদুলের পদশব্দ দূরে নেবে হারিয়ে গেল। আর কিছুই সে ভাবতে পারছে না, সমস্ত অনুভূতি যেন তার অবশ হয়ে গেছে। শুধু ঘুম পাচ্ছে। এক সময়ে আধো ঘুম আধো জাগার ভেতরে সে শুনতে পেল কিছুটা কাছেই, অথচ কাছেও নয়, একটা দরোজা বন্ধ হয়ে গেল। তার ঝাঁকুনিতে বুঝি একটু শিরশির করে উঠল কাঠের দেয়াল। হারিকেনের ছোট্ট সলতেয় কামরার ভেতরে দীর্ঘ চিকন কাঠের প্রাঙ্কের অসংখ্য সমান্তরাল রেখায় ছায়ার ভাঁজ পড়েছে। অন্ধকার লাগছে তাব ক্রীমরঙ পেন্ট। ফারুক ঘুমিয়ে পড়ল ধীরে ধীরে।
অনেক রাতে কী করে যেন ঘুম ভেঙে গেল তার। কী একটা ধ্বনিতে, কিসের একটা নরোম শব্দে সে জেগে উঠল। এমন কিছু নয়, খুব মিহি, তবু তার ঘুম ভাঙলো। প্রথমটায় তন্দ্রা, তারপর চোখ মেলে তাকাল ও। ওপরে সিলিংয়ে শুধু পুঞ্জীভূত অন্ধকার।
চোখ সয়ে এলে পর কান পাতলো শোনবার জন্য। কে যেন হাঁটছে তার কোমল পা ফেলে, সাবধানে আর ধীরে। বুকের ভেতরে গিয়ে সেই পদশব্দ যেন ঢেউ তুললো। রক্তে তার নামলো আশ্চর্য অনুরণন। আর জাগলো বিচিত্র একটা অনুভূতি। থেমে গেল সেই শব্দটা। ফারুক উঠে বসলো। জানালার পাশে দুধ–সুপুরির একটা উন্নত ডালে বাতাস উঠলো শিরশিরিয়ে। সেও সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো।
রেলিং ধরে একেলা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল তাহমিনা। সে এসে দাঁড়াল ঠিক তার পেছনে। রাত্রির অতল থেকে গড়ে উঠেছে যেন তাহমিনার শুভ্র দেহ! শিথিল শাড়ি সরে গেছে মাথার ওপর থেকে। একরাশ চুল কাজল মেঘের মত অথবা এই অরণ্যের মত বিস্তৃত তার পিঠের ওপরে। আর তার মিহি সৌরভ বাতাসে। বাইরে বেলে জোছনা। এমনি কোনো চন্দ্ররাতে হরিণ আর হরিণীরা বুঝি টের পায় কিসের আভাস। নির্জন তাদের বাসা ছেড়ে ঘাসের ভিতর দিয়ে পরস্পর নদীর জল শেষে। ফারুক অনুভব করল এক আকর্ষণ। সে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে। দাঁড়াল। তাহমিনা চকিতে মুখ ফিরিয়ে তারপর শ্বাস ফেলে উচ্চারণ করল, ও, তুমি।
ফারুক বলল, এখনো ঘুমোও নি তাহমিনা?
তাহমিনা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল অন্ধকারে। কোনো কথা বলল না। একটু চুপ কবে থাকল ফারুক। তারপর এত নিচু গলায় বলল যে তার কথা প্রায় শোনা গেল না, আমি চলে গেলেই ভালো ছিল। শুধু শুধু আমাকে ধরে রাখলে। এমন হবে জানলে আমি আসতাম না।
কী জানলে?
আমি বলে বোঝাতে পারছি নে।
তুমি যেতে চাইলে আমি বাধা দেবার কে?
সে কথা নয় তাহমিনা, একটু থামল, ও নেই, তাই বলছিলুম।
তুমি পাগল। তুমি ঘরে যাও।
ফারুক দূরে ঘন ঝোঁপের দিকে তাকিয়ে রইল খানিক। তারপর সেদিকে চোখ রেখেই বলল, তোমার ভয় করে না? এক বাংলোর নিচে একেলা আর একজনের সাথে থাকতে তোমার ভয় হয় না?
তাহমিনা হাসল মৃদুস্বরে। একটু সরে গেল রেলিংয়ে।
তাহলে তোমাকে থাকতে বলতাম না।
প্রসঙ্গটা চাপা দেবার জন্যেই ফারুক একটুখন পর বলল, তোমার চিঠি পেয়ে এক মুহূর্ত আমি দেরি করিনি। সমস্ত কাজ ফেলে এসেছি তোমার কাছে।
আমি জানতাম।
হঠাৎ আমাকে তুমি আবার লিখলে কেন তাহমিনা?
একটু যেন চমকে উঠল ও। মুহূর্তের জন্য বুঝি ম্লান হয়ে গেল তার মুখ। উন্নত বুক তার স্ফীত হয়ে উঠল। কয়েকটা দৃঢ় টোল পড়ল গালে। ছায়াভাঁজ। মিলিয়ে গেল। কী যেন সে বলতে চাইল। অথচ পারল না। চলে যেতে চাইল। ফারুক স্পর্শ করল তার বাহুতে। তুলে নিল মুঠোয়। বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে গেল সেই স্পর্শ পরস্পরের ভিতরে। বলল, শোনো, তুমি চলে যাচ্ছ?
তাহমিনা দাঁড়াল, কিন্তু সরিয়ে দিল না তার স্পর্শ। অদ্ভুত তীক্ষ্ণ এক দৃষ্টি মেলে তাকাল তার দিকে। ফারুক বোকার মত হাত সরিয়ে নিল, আমি দুঃখিত তাহমিনা, একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।
০৮. সকালে চায়ের পেয়ালায় দুধ ঢেলে
সকালে চায়ের পেয়ালায় দুধ ঢেলে চিনির পট হাতে নিয়ে অত্যন্ত সহজ সুরে, যেন কিছুই হয়নি এমনি কণ্ঠে শুধালো তাহমিনা, কচামচ চিনি দেব?
একটা।
এখনো চিনি কম খাও? আশ্চর্য।
কিশোরী–কুমারীর মত সুন্দর হাসি মাখল ও সারা মুখে। রিনটিন চুড়ি বাজলো চিনি নাড়তে গিয়ে। বুকের শাড়ি একটু নত হল সমুখের দিকে।