আশরাফ একটুখন চুপ করে রইল। তারপর শুধালো, তোর মেমসায়েব কোথায়?
উনি তো ভেতরে।
হুঁ।
এরপরেই আশরাফ এসে দাঁড়াল দরোজায়। ফারুক চোখ তুলে তাকালো। আশরাফের আসল বয়স বিয়াল্লিশের বেশি হবে না। কিন্তু চট করে দেখলে ঠাহর করা যায় না। আরো বেশি মনে হয়। কপালে দুটো ভাঁজ পড়েছে। তীক্ষ্ণ নাক। আর স্কুট চোয়ালের হাড়ে দৃঢ়তার। ছাপ। প্রশস্ত কাঁধ। লম্বায় প্রায় ছফুট কি তারো বেশি হবে। দীর্ঘকাল অরণ্যে কাটিয়ে মজুর খাঁটিয়ে চেহারাটা তার কঠিন হয়ে এসেছে অস্বাভাবিক রকমে। এখন পরনে তার ভাঁজ দুমড়ানো পাঞ্জাবি পাজামা। বাঁ হাতে দুব্যাটারির ছোট্ট তীব্র টর্চ। ডান হাতে রাইফেল। ফারুক একটু অস্বস্তি বোধ করল, বিব্রত হলো। তারপর উঠে দাঁড়াল। আশরাফ হেসে বলল, আরে বসুন, উঠছেন কেন? এ অরণ্যে তার বালাই আমরা রাখিনি। সব ক–বে ভুলে মেরে দিয়েছি।
বলেই উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল আশরাফ। ফারুক প্রথমে বিস্মিত হলো, তারপর নিচু গলায় সেও হাসিতে যোগ দিল। তার সম্বন্ধে যে ধারণা সে প্রথমে করেছিল এক মুহূর্তে তা কেটে গেল।
ঢাকা থেকে আসছেন বুঝি?
হা। ফারুক শুকনো গলায় বলল।
আবিদের ব্যাপারটা শুনেছেন তো? বড় বিপদে পড়ে গেছি সবাই। এ সময়ে আপনি এলেন। ভালো কথা, আপনার পরিচয়টা আমার জানা হোলো না।
ফারুক কিছু একটা বলবার আগেই দরোজার কাছ থেকে এই মাত্র সে এসে দাঁড়িয়েছে—- তাহমিনার উত্তর এলো, ও আমার মার সম্পর্কে ভাই হয় আশরাফ সায়েব।
দুজনেই প্রায় একসাথে তার দিকে ফিরে তাকাল, আপনি দেখেন নি ওকে। অনেকদিন। থেকেই আসতে চেয়েছিল এখানে বেড়াতে। তারপর তাহমিনা ফারুকের দিকে তাকিয়ে বলল, আর ইনি আমাদের ফার্মের সব, আশরাফ আহমদ।
তাহমিনা শান্ত স্বরে প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ভেতরে এসে বসল। হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে এসেছে ও। অনেকটা স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ওকে। ফারুক একবার তার দিকে তাকাল। ঘরে কিছুকাল তীব্র নিস্তব্ধতা। অবশেষে আশরাফ প্রথমে বলল, ও তারপর বলল, ঘাটে আলো দেখে ভাবলুম তুমি এসেছ। তাই উঠে এসেছি। খবর কী?
ভালো। —-ভালোই।
ডাক্তার কী বললেন?
উনি তো আশা রাখছেন এখনো।
পা কি বাঁচানো যাবে?
তাই তো বলছেন।
যাক তবু ভালো। আমার একবার যাওয়া দরকার আবার দেখতে। কিছু বলেছে নাকি আমার কথা?
তাহমিনা একটু অন্যমনা হয়ে পড়েছিল। চকিতে চমক ভেঙে বলল, না, বলে নি।
নতুন কয়েকটা বড় অর্ডার এসেছিল, তাই বলছিলাম। দেখি কি করা যায়।
তাহমিনা কোনো কথা বলল না। আশরাফ হঠাৎ ফারুকের দিকে তাকিয়ে বলল, এ সব কাজ বুঝলেন ঝামেলার একশেষ। একা কুলিয়ে ওঠা যায় না। এসেছেন, সবি দেখবেন আস্তে আস্তে।
ফারুকের একটা কিছু বলা দরকার, সে অনুভব করল, তাই বলল, সে তো নিশ্চয়ই।
দেখছেন তো কাঠের কারবার, কিন্তু ধারণা করতে পারবেন না কী কাঠখড় এর পেছনে পোড়াতে হয়।
ফারুক একটু হাসল শুধু। তাহমিনা তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কাপড় বদলালে না? আবদুল চা নিয়ে আসছে এখুনি।
হু, বদলাচ্ছি।
আশরাফ বলল, তাই তো, আপনার এসব এখনো হয় নি। আমার খেয়ালই ছিল না। রাত তো অনেক হয়েছে। আচ্ছা তাহমিনা, আমি তাহলে যাই। আসি আমি, কাল সকালে আপনার সাথে আলাপ করব।
আশরাফ উঠছিল। ফারুক বাধা দিল, বসুন চা খেয়ে যাবেন।
খেপেছেন! এই রাতে চা খেলে ঘুম হবে মনে করেছেন? তার ওপর বাসায় ও আবার জেগে রয়েছে।
এমন কিছু দেরি হবে না আপনার একটু বসলে। তাছাড়া চা খেলে রাতে ঘুম হয় না কে বলল?
তাহমিনা বলল, বসুন না। এক কাপ চা–ই তো। আবদুল, আবদুল।
আচ্ছা।
আশরাফ চেয়ারে একটু আড় হয়ে বসলে৷। আবদুল এলে পর তাহমিনা বলল, যাও ওকে বাথরুম দেখিয়ে দাও। যাও তুমি।
.
আবদুলের সাথে করিডর ঘুরে পেছনের বারান্দার শেষ প্রান্তে বাথরুমে ঢুকলো ফারুক। আবদুল হারিকেনটা এগিয়ে দিল। টাবে পানি তোলা রয়েছে কানায় কানায়। র্যাকে পরিষ্কার টাওয়েল রাখা। দেয়ালে লম্বা আয়না। আর তার নিচেই কেসে রাখা নতুন সাবানের শুভ্র কেক। সমস্ত মেঝে সদ্য ভিজে। আর কেমন একটা চেনা মিষ্টি সুবাস বাতাসে। শিরশির করা! ফারুক কেকটা তুলে নিল।
সমস্ত কিছুই তার কাছে কেমন রহস্যময় আর অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো। কদিন আগেও সে কি ভাবতে পেরেছিল তাকে এখানে আসতে হবে? তাহমিনার সাথে দেখা হবে? আর ওর ব্যবহারটা অদ্ভুত ঠেকল তার কাছে। চিঠি পেয়ে, এমন কী এখানে এসে অবধি আকাশ পাতাল অনেক কিছু মনে হয়েছিল তার। কিন্তু তাহমিনা অস্বাভাবিক রকমে শান্ত স্নিগ্ধ আর উজ্জ্বল। কত সহজে সে তার পরিচয় নিজে দিল আশরাফের কাছে। ও কেন লুকালো তার আসল পরিচয়? কী হয়েছে তাহমিনার? আবিদের দুর্ঘটনা যে এর কারণ নয় তা সে বুঝতে। পারল। তাহলে কী? চোখের সমুখে একবার তাহমিনার চেহারাটা মনে করতে চেষ্টা করল সে।
ফিরে এল যখন, তখন নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হোল তার। আবদুল এর মধ্যেই সব কিছু সাজিয়ে ফেলেছে। রেকাবিতে রাখা পুডিং আর রূপোর চামচ। ট্রের ওপর ঢাকনা দেয়া কেটলি। চা ঢেলে দিল তাহমিনা। তিনজনে হাতের ওপর টেনে নিল সোনালি বর্ডার দেয়া নীল ফুল তোলা সোনালি পানিয়ের কাপ।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে আশরাফ গল্প করতে লাগল—-বার্মার গল্প, ইরাবতী তীরের কথা। কথাটা উঠল আবিদের দুর্ঘটনা থেকে। তখন আশরাফ আবিদের বাবার সাথে ইরাবতীর তীরে নতুন জঙ্গলের ইজারা নিয়ে ঘুরছে। কাটা হচ্ছে গাছ। হাতি দিয়ে গড়িয়ে নদীর কিনারে নিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে ভেলা বেঁধে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কুলিরা। আশরাফ দাঁড়িয়ে তদারক করছিল। সেই সময় মাঝ নদীতে এক কুলি পড়ে যায় হঠাৎ। একই দুর্ঘটনা ঘটেছিল তারো। তবে কুমির নয়, কুমিরের সগোত্রই এক জলজ জন্তু কামড়ে ধরেছিল তার পা। আর সেকি তার বুক ফাটা আর্তনাদ! শেষ অবধি যখন তাকে তীরে তুলে নিয়ে আসা হলো তখন স্রোতের মত ধারায় রক্ত পড়ছে। আশরাফ এরপর একটু থেমে বলল, অবাক হয়েছি সবচে, বুনো লতাপাতা খেয়ে–বেঁধে লোকটা সেরে উঠেছিল। অনেকদিন আগের কথা, এখনো স্পষ্ট আমার মনে আছে। কাজেই ভয়ের কিছু নেই তাহমিনা। আচ্ছা, এবার তাহলে, আমি চলি। আশরাফ ফারুকের দিকে মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। তুলে নিল টর্চ আর রাইফেল। একবার রাইফেলটা ঝাঁকাল, তারপর চলে গেল। ফারুক তার পেছনে পেছনে তাকিয়ে রইল। আবদুল আস্তে আস্তে সব নিয়ে গেল। এখন শুধু নিস্তব্ধতা। কেউ কোন কথা বলল না। কেউ কারো দিকে তাকাল না। হঠাৎ যেন স্তব্ধ স্পন্দনহীন হয়ে গেছে সবকিছু এক নিমেষে।