নিচে, তাহমিনা উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। পেছনে কে একজন। সম্ভবত মাঝি কিংবা খানসামা কেউ হবে। তাহমিনা পেছন পানে তাকিয়ে উঠতে উঠতে বলছে, বাতিটা একটু ভালো করে ধর গফুর। পা হড়কে যেতে পারে। কে আবদুল?
ফারুক প্রার্থনা করল অন্ধকারের সাথে মিশে যাবার জন্যে। কিন্তু কিছুই সে করল না। শুধু একটুখন পরে উচ্চারণ করল অত্যন্ত নিচু গলায়, আমি তাহমিনা।
নিস্তব্ধতা।
ও। তুমি।
তাহমিনা মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। হারিকেনের মৃদু মালোয় তাকাল পরিপূর্ণ গভীর চোখে। তারপর তার দৃষ্টি হয়ে এল শূন্য। ফারুক সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল না। কেউই নিল না। তিন বছরে আরো সুন্দর হয়েছে তাহমিনা। নেবেছে আশ্চর্য ডার্ক আইভরির মসৃণতা। আর তাহমিনার সেই চঞ্চলা দেহে এখন মন্থরতা। চিবুকের সেই কোমল ভাঁজ এখনো রয়েছে। তেমনি ঈষৎ উত্তোলিত তার—-ভঙ্গ। কুয়াশা লাল ঠোঁট। উন্নত গ্রীবা। আরো একটু বয়স হয়েছে তাহমিনার স্নিগ্ধ লাবণ্যের ছায়া পড়েছে মুখের আদলে। আর অলসতর তার শ্রোণীর। ফারুক দেখল। ফারুক সম্মোহিত হলো। কিন্তু তাহমিনা দাঁড়াল। মুহূর্তের জন্য। তারপর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বলল, ফিরে যাচ্ছিলে? কতক্ষণ এসেছ?
এ প্রশ্নের উত্তর নেই। আবদুল নীরবে ফিরে গিয়ে তালা খুলল। তাহমিনা এক পা ভেতরে গিয়ে তারপর ঈষৎ আনত পেছন ফিরে শুধালো, ভেতরে আসবে না?
.
ফারুক আবার গিয়ে ঠিক সেইখানে সেই চেয়ারে বসলো। এবারে দেখা দিল নতুন একটা সমস্যা। এতক্ষণ তবু তাহমিনা ছিল না, এখন সে এসেছে–ফারুক তার অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারল তীব্র করে। সে স্থির হয়ে, হয়ত কিছুটা বিসদৃশভাবে, বসে রইল। দূরে দাঁড়িয়ে আবদুল। আর তারো কিছুটা পেছনে তাহমিনা প্রায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। ফারুক তার পায়ের তলায় অনুভব করল কার্পেটের কোমলতা। আর শুনল তাহমিনা বলছে, পেট্রোম্যাক্স জ্বালো নি আবদুল?
না মেম সায়েব। আপনি নেই তাই আর ওটা জ্বালি নি। জ্বালব কী?
না থাক, এখন আর দরকার নেই। এইখানে সে তাকাল ফারুকের দিকে। ফারুক একটু পরে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন উনি?
তাহমিনা প্রশ্নের দৃষ্টিতে একবার ফারুক তারপর আবদুলের দিকে তাকাল। সংশোধনের হাসি হেসে বলল ফারুক, হ্যাঁ, ওর কাছ থেকেই শুনেছি।
তাহমিনা উত্তর করল, কিছুটা কম্পিত স্বরে, প্রায় আগের মতই। কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
ডাক্তার কী বললেন?
এ প্রশ্নের কোন উত্তর পেল না ফারুক। তা না পাক। উত্তর তাহমিনার মুখেই লেখা ছিল। তাই আর সে কোনো প্রশ্ন করল না। তাহমিনা কোনো কথা না বলে রূপসার মত মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। অপসারিত হলো মেঝে থেকে তার দেহছায়া। আবদুলও চলে গেল প্রায় সাথে সাথে।
আবদুল ফিরে এসে বলল, মেম সায়েব শুধোচ্ছিলেন—- খাবার কথা।
খাবার ইচ্ছে নেই আবদুল। তুমি বরং ওকে ডাকো।
কিন্তু জিজ্ঞেস করলেন কি খাবেন জেনে আসতে।
সন্ধ্যের আগেই খেয়ে নিয়েছি। এত রাতে মিছেমিছি কষ্ট কোরো না।
সেকি কথা হুজুর!
অবশেষে ফারুক বলে দিল শুধু চায়ের কথা। আবদুল বলল, তার আগে চলুন হাত মুখ ধুয়ে নেবেন।
ফারুক উঠতে যাচ্ছিল। এতটা পথ স্টিমার আর লঞ্চে এসে অনেকটা শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল সে। ঘুমে ভারী হয়ে আসছিল চোখ। আঠার মত সারা গায়ে যেন ট্রাউজার আর শার্ট সেঁটে আছে। সেগুলো না ছেড়ে রাখা অবধি কিছুতেই স্বস্তি আসবে না। এমন সময় সিঁড়িতে বাইরে কার পায়ের আওয়াজ আর গলা শোনা গেল, আবদুল, আবদুল।
আবদুল প্রায় ফিসফিস স্বরে ফারুককে বলল, আশরাফ সায়েব আসছেন—- হুজুরের ম্যানেজার সায়েব।
ও।
বলেই সে বাইরে এগিয়ে গেল।
এমন একটা বিশ্রী অবস্থায় ফারুক যে এত শীগগীর এমনভাবে পড়ে যাবে তা সে এর আগে ভাবতেও পারে নি। সে আশা করে নি এত তাড়াতাড়ি বাইরের কারো সামনে তাকে আসতে হবে। কি দেবে তার পরিচয়? আর কেনই বা সে এখানে এসেছে, তার জবাবেই বা কি বলবে? কিছু না জেনেও তার স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেছে যে তাহমিনার চিঠির কথা কাউকে সে বলতে পারবে না। এই সময়ে চকিতে তার চোখের সামনে আরেকবার ভেসে উঠল চিঠিটা—-দ্রুত হস্তাক্ষরে বাঁকা দুর্বল লাইনে লেখা তাহমিনার চিঠি। আর সে যেন স্পষ্ট শুনতে পেল তাহমিনার স্বর—- “যদি কোনোদিন আমাকে তুমি তোমার একান্ত বলে ভেবে থাকো, তাহলে এ চিঠিকে তুমি উপেক্ষা করবে না, এ আমি জানি।” ফারুক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হরে চেয়ারে নিঃশব্দে আবার বসে পড়। ভ্রমণের ক্লান্তি যেন তাকে এখন ছুঁয়ে গেল গভীরতর। উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
বাইরে থেকে আশরাফের গলা শোনা গেল, কিরে আবদুল, তোর মেমসায়েব ফিরলেন নাকি এখন?
হ্যাঁ।
আবিদের খবর কী?
একই রকম তো বল্লেন। আর কিছু শুনিনি এখনো।
কাল তো ফেরার কথা ওর। আজকেই ফিরল যে?
কী জানি।
আশরাফ একটু কাশলো। তারপর আবার বলল, হঠাৎ কড়ানাড়ার শব্দ, তারপর অনেকক্ষণ পরে আবার ঘাট থেকে আলো দেখে ভাবলাম দেখে আসি একবার। ঘুমোস কত যে অমন করে দরজা ধাক্কাতে হয়? চল, চল, ভেতরে চল শুনি।
আবদুল গলা একটু নামিয়ে বলল, ফারুক তবুও শুনতে পেল, নতুন এক সায়েব এসেছেন, তিনিই কড়া নেড়েছিলেন।
কে সায়েব রে?
ফারুক স্থির হয়ে বসল। আবদুল উত্তর করল, ঢাকা থেকে এসেছেন। আর মেমসায়েব তো এলেন এইমাত্র।