আবার নিঃশ্বাস ফেলি মুক্তির। কারণ, তখন হঠাৎ সব তুচ্ছ হয়ে যায়। হাসি পায়। ভাবি, আমি ব্যাচেলের বলেই আমার ম্যানিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে–কোনো কন্যাদায়গ্রস্ত লোককে সন্দেহ করা। আর এ–ও বোঝাই নিজেকে তুমি তো বেশ লোক হে? কাজি সাহেব বললেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। তুমি যদি না করো তো সাধ্য কী তোমাকে রাজি করায়। এ নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করবার, ভয় পাবার কী আছে?
কিন্তু ভয় হতো। ভয় হতো, যখন কোনো কোনো রাতে, ফাঁকা চেম্বারে আমি আর কাজি সাহেব বসে থাকতাম আর উনি অহেতুক প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন পরিবারে; বড় ছেলেটার যে ফেল করে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছোট মেয়েটা যে এবার নাচের স্কুলে ভর্তি হবে বলে বায়না ধরেছে, স্ত্রীর অসুখ লেগেই আছে, তিনি আর কত দিন বাঁচবেন, দীর্ঘনিঃশ্বাস, শ্যালকেরা কেউ মানুষ হলো না, প্রতিবেশীর সঙ্গে পেছনের জমির মালিকানা নিয়ে মামলা এবং রুমিটা বড় হচ্ছে–এইসব শুনতে শুনতে আমার ভয় করত। আমি হাঁ–নার বেশি কিছু বলতে পারতাম না। আমার তখন উঠে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু ওঠবার আগেই, দৈবেরই কী ইচ্ছা আমাকে হেনস্তা করবার, দেখতাম রুমি এসে দাঁড়িয়েছে; বলছে–আপা রাতে আপনাকে খেয়ে যেতে বলেছে, আমার তখন হৃৎস্পন্দন বন্ধ হবার যোগাড়। যেন একটা ষড়যন্ত্রের আভাস দেখতে পাই চারদিকে, সব কিছুতে। রুমির এই হঠাৎ আসাটাকে কাজি সাহেবের সুচিন্তিত একটা চাল মনে করে শিউরে উঠি।
গোড়ার দিকে বুঝতেই পারতাম না, এত ভয় কিসের? রুমি কালো বলে? কুৎসিৎ? না, সে রুচিতে শ্রীমতি নয় বলে? আচ্ছা যদি রুমি দেখতে খুব ভালো হতো? ফর্সা হতো? নিশাতের মতো। তাহলে?
নিশাতকে বলতে পারতাম না। মেয়েরা এ ধরনের কথা শুনতে আদৌ পছন্দ করে না, তারা খেপে যায়–এ রকম একটা ধারণা আমার আছে। হোক রুমি কালো, দেখতে ভালো না, চাই কি নিশাত একটা ফালতু ঝামেলা করে বতে পারে। তাছাড়া বলব কী, নিশাতের কাছে যতক্ষণ থাকি বিশ্বসংসারের আর কারো কথা মনে পড়ে না আমার। রুমিকে নিয়ে দুর্ভাবনার সীমা ঐ চেম্বার পর্যন্তই। আর কখনো কখনো যখন গাড়িতে ওর সহযাত্রী আমাকে হতে হয়। পরে একদিন আবিষ্কার করেছি ভয়ের কারণটা। চিন্তা করে নয় ভাবনা করে নয়, কিছু না। একটা রেস্তোরাঁয় বসে কফি খাচ্ছি–কালো, দুধ ছাড়া কোন একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম কে যেন কালো কফি খেতে ভালবাসত সেই থেকে অভ্যেসটা। নাকে এসে লাগছিল রকফির ঝাঁঝালো মিষ্টি ঘ্রাণ আর ধোঁয়ায় বারবার মেঘলা হয়ে যাচ্ছিল আমার চশমার কাঁচ, তখন হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেললাম কারণটা।
ভয় আমার জীবিকার উপার্জনের, প্রতিষ্ঠার। কাজি সাহেব যদি বলেন আর আমি রুমিকে বিয়ে না করি, তাহলে আমাকে তার চেম্বার ছেড়ে দিতে হবে– এইটেই আমার অজ্ঞাতে জন্ম দিয়েছে ঐ ভয়টার। কাজি সাহেবের মতো খ্যাতনামা, প্রতিপত্তিসম্পন্ন এ্যাডভোকেটের জুনিয়র হতে পারাটা ভাগ্যের কথা; পশার তার অমিত সম্ভাবনায় ভরা। সেই কাজি সাহেব যদি আমাকে খারিজ করে দেন তো আমাকে পথে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে জীবন। আবার সেই সংগ্রাম। মাসে যে আজ আমার শচার পাঁচেক আসছে– এর ধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ আমার সব স্বপ্নের মৃত্যু।
আমি তো জানি কী ভীষণ এই একাকীত্ব, এই টাকা না থাকাটা, এই লড়াই।
ছোটবেলায় বাবা মারা যাবার পর, আমার তখন চার বছর বয়স শুনেছি, মার আবার বিয়ে হলো। আমাকে রেখে গেলেন চাচাদের হাতে। তার নতুন স্বামীকে দেখিনি কখনো। মা কেও তারপর থেকে আর কোনদিন না। চাচাদের কাছে ভয়ঙ্কর বর্ণনা শুনতাম। লোকটা খুব চাষা, চোয়াড়ে আর বিস্তর টাকা তার। মামারা কেউ ছিলেন না, মামা–বাড়ির অবস্থা ছিল খুব খারাপ। মা–কে তাই আবার নতুন ঘর করতে যেতে হয়েছিল। আমার এসব কিস্সু মনে নেই। কেবল একটা ছবি মনে আছে, আমাকে কোলে করে দলা করে ভাত পাকিয়ে ছড়া বলতে বলতে মা খাইয়ে দিচ্ছেন। চেহারাটা মনে নেই। ঘরে একটা ডিবে জ্বলছে। খুব ধোঁয়া হয়েছে। আর একটা ছবি, গোরস্তানে বাবাকে ওরা কবর দিতে নিয়ে গেছে। আমিও গেছি। আমি আমার সমান কয়েকটা ছেলের সঙ্গে দূরে একটা ভাঙা কবর থেকে ছাতার গোড়া দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলছি একটা মড়ার খুলি আর খুব মজা পাচ্ছি। খুব রোদ বলে আমাকে ছাতাটা দিয়েছিল। খুলিটাকে গড়াতে গড়াতে নিয়ে যাচ্ছি বালু–বালু মাটির ওপর দিয়ে, থানকুনি পাতার ভেতর দিয়ে, কারা যেন গাদা ফুলের গাছ লাগিয়েছে তার দিকে। মেলা ফুল ফুটেছে হলুদ হলুদ। ছাতাটাকে আমি কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না। এমন সময় কে একজন এসে বলল, গ্যাদা, শীগগীর আসো। তোমার বাপেরে না মাটি দিতাছে, দেখবা না? ব্যাস এইটুকু। আর কিছু মনে নেই। আমি গিয়েছিলাম কী গিয়েছিলাম না, দেখেছিলাম কী দেখেছিলাম না কতদিন ভাবতে চেষ্টা করেছি একেবারে শাদা, কুয়াশার মতো। কিছু মনে পড়ে না।
চাচারা খুব কালো মুখ করে দেখতেন আমাকে। আমি সেই ছোটবেলা থেকেই জানতাম, যাদের বাবা নেই তাদের কেউ নেই। ইস্কুলে আমাদের হেডমাস্টার ক্লাশের ছেলেদের বলতেন, ওর সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করো না যেন। ওর বাবা নেই! ওর কত দুঃখ। দুঃখের কথা শুনে খুব আবছা একটা গর্ব হতো তখন। আমি সবার থেকে আলাদা। ক্লাশে একদিন ইংরেজির স্যার অরফান শব্দের বাংলা বলতে গিয়ে উদাহরণ দিলেন আমাকে। ভারী ফুর্তি হলো আমার। এখন মনে পড়লে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। আবার ভাবি, বেশ ছিলাম তখন। দুঃখকে দুঃখ মনে হতো না, আনন্দকে বুঝতে পারতাম না তখন। মানুষ বড় হলেও যদি এ রকম হতো তাহলে তাকে বুঝি সুখী বলতো সবাই। কিন্তু ওটাতো অবোধের কাল। এখন এই যে আমি বড় হয়েছি, দুঃখ হলে দুঃখটাকে একেবারে ভেতর থেকে নিংড়ে নিংড়ে বেরোতে দেখছি, এক ঝলক আলোর মতো আবার আনন্দে ভরে উঠছি আর সেই আনন্দটুকু স্মৃতির মধ্যে প্রদীপের মতো জ্বলছে, এই শক্তিটার নাম বোধ হয় জীবন।