তাকিয়ে দেখি নবাবপুর রেলওয়ে ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে আছি আমি। রেল গেটটা বন্ধ। একটা ট্যাক্সি থমকে দাঁড়িয়ে আছে তার সমুখে। কয়েকটা মুখ ভেতরে। যেন এই প্রথম আমি এক মহাপ্লাবনের পর মানুষের মুখ দেখলাম। ক্ষুধার্তের মতো তাকালাম তাদের দিকে। ট্যাক্সির গায়ে ফুলের ম্লান মালা জড়িয়ে আছে, কয়েকটা ফালি ফালি আলো ভেতরটা খণ্ডিত ছবির মতো করে তুলেছে।
নিশাত। সে আমাকে চোখ তুলে দেখল।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ভিখিরি এই এত রাতেও কোথা থেকে এসে হাত বাড়ালো আমার সমুখে। আমি এ–পকেট ও–পকেট হাতড়ে একটা আনি বার করলাম। একটা ইঞ্জিন মাথার ওপরে আগুনের ফুলঝুরি ছড়াতে ছড়াতে চলে গেল। ভিখিরিটা গিয়ে দাঁড়াল ট্যাক্সির কাছে। আবার সে হাত বাড়াল।
চলতে লাগল ট্যাক্সিটা। ক্রসিং বারের লালবাতিটা দুলতে দুলতে স্থির হয়ে গেল আকাশে। কুক্কমে সাজানো বিয়ের শাড়ি পরা নিশাত। পাশে তার বর। বিয়ের শেষে ফিরে যাচ্ছে ওরা ওদের বাসরে। বরের মুখ আমি দেখতে পেলাম না।
বন্ধুদের নামগুলো ঘুরতে লাগল আমার ভেতরে, কিন্তু আর ডাকতে পারলাম না আমি। নিশাত। ঝাঁপিয়ে পড়া দুরন্ত মমতায় আর সমস্ত কিছু স্থির হয়ে আসা অতল ভালোবাসায় আমি বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
না কি স্বপ্ন দেখছি?
তখন আমার মাথার মধ্যে একটা জলপ্রপাত যেন হঠাৎ বিশ্ব ডোবানো গর্জন করতে করতে নেমে এলো, যার পুঞ্জিভূত, উৎক্ষিপ্ত, ফুলের মতো কোটি কোটি শাদা ফেনায় আমি প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম অবিশ্বাস্য, নতুন, চিরন্তন, মর্মরিত এক সুন্দর।
একটা স্কুটার এসে বিকট শব্দ করে থামল আমার পাশে। এক মুহূর্তে আমার সবকিছু ফিরে এলো আমার কাছে। ড্রাইভার গলা বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, সাব কহি যানা হ্যয়?
বললাম, হ্যাঁ কহি তো যানা হয়। মুঝে ঘর পহচা দো।
আমাকে নিয়ে স্কুটার ছুটে চলল সেই পরিচিত প্রচণ্ড শব্দ, গিয়ার ফেঁসে যাওয়ার করুণ আর্তনাদ, চাকার নিচে অসমতল রাস্তার ধাক্কা। ড্রাইভার জানে না যাকে সে উঠিয়েছে আর যাকে সে নামিয়ে দেবে তারা দুজন এক নয়। রাত্রির ভেতর দিয়ে ঘুমন্ত শহরের রাজপথে একটা মৃত্যু থেকে জন্মের দিকে চলেছে তার স্কুটার।
নয়াপল্টন, ঢাকা
১৯৬৩