আজ আমি ভাবি, ওটা কি সত্যি সত্যির পর্যায়ে পড়ে? আজ যখন মার মুখে কথাটা শোনবার পর একটি বছর চলে গেছে, নিশাতের সঙ্গে আবার অপ্রত্যাশিত আমার দেখা হয়েছে, আমি খানিকটা পারছি নিরপেক্ষ দূরত্ব থেকে পুরো ঘটনাকে দেখতে।
তিন সাড়ে তিন বছরের শিশু যা করছে তা কি সজ্ঞান মানুষের জন্যে প্রযোজ্য আইন দিয়ে দেখা সম্ভব? না, উচিত?
কিন্তু যা ঘটে গেছে তা সত্য। আমার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সজ্ঞানে কী অবোধ-চেতনায় যে মৃত্যু আমি এ দুহাতে একদা ধারণ করেছিলাম তাকে অস্বীকার করবো কী করে?
.
নির্জন ঘরে এখন রাত্রির নিস্তব্ধতা তাকিয়ে আছে আমার দিকে তার গভীর চোখ মেলে। বাতি জ্বালিয়ে লিখছি, লিখতে লিখতে ঘামছি, আবার লিখছি। খেই হারিয়ে যাচ্ছে কথার, স্মৃতির পল্লবিত শাখার সহস্র পাতায় লাগছে ঝড়ের মাতন, মনে হচ্ছে আমি বিশ্বের সবচে একা অথচ বিশ্বের সঙ্গে আমার বন্ধন এত যে নিবিড় তা এর আগে এমন করে আর উপলব্ধি করিনি। আমার জীবন–কাহিনীর কোনো সুস্পষ্ট শুরু নেই, ধারাবাহিকতা নেই স্মৃতির কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ছবির অ্যালবাম নিয়ে আজ আমি আমার হারানো ভালোবাসার সন্ধান করছি। আবার আমি সৃষ্টি করতে চলেছি পিতাকে আমার আদর্শ, কর্ম আর লক্ষ্যের মধ্যে। আমার যন্ত্রণার উপশম হচ্ছে এই রচনার মাধ্যমে। যা ঘটে গেছে তা আর ফেরাতে পারব না; কিন্তু লেখক হয়ে লিখতে পারব যা ঘটতে পারত–আমার লেখায় সাজাতে পারব অভিজ্ঞতা, মূল্যবোধ, আর জীবনকে, যেন আমি চেয়েছিলাম সৃষ্টি করতে পারব মানুষ, যেমনটি আমি নিজে হতে পারিনি।
.
কিন্তু লেখক হবার এই সিদ্ধান্তটাও আকস্মিক। একেবারে একটা ঝড়ের মতো। সেদিন ছিল এরকম—
গোবিন্দর দোকানে রোজকার মতো বসেছিল তাসের আড্ডা। এই আমি প্রথম ক্রমাগত হারছিলাম। বন্ধুরা খুব অবাক হচ্ছিল এবং একজনকে বেশ লজ্জিত মন হচ্ছিল তার জিতবার পরমুহূর্তে। আমি বললাম, তাতে কী আছে? চলুক না? কিন্তু খেলা চলল ধুকে ধুকে– কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। আমি ওদের মেজাজ ফিরিয়ে আনবার জন্যে প্রস্তাব করলাম, চলো কোথাও যাই। খানিকটা গেলা যাক। আর যদি পাওয়া যায় বলে বা চোখ ছোট করলাম।
ওরা হৈ হৈ করে উঠে দাঁড়াল। বলল, চমৎকার। চমৎকার। আজ থাক তাস পড়ে।
বেরিয়ে কোথাও পাওয়া গেল না কিছু। সব বারই বন্ধ হয়ে গেছে। একটা মেয়েমানুষের বাড়ি আমাদের জানা ছিল যেখানে খানিকটা মদ রাখা থাকত। আমার বন্ধুরা বলল, চলো সেখানে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, বন্ধুরা আমাকে স্ফুর্তিতে রাখবার জন্যে কী আকুলি বিকুলিই না করছিল সে রাতে। আমি যে বারবার তাসে হেরে যাচ্ছিলাম, ওরা ধরে নিয়েছে, আমার মনটা খুব দমে গেছে। একটা পয়সা খরচ করতে দিল না আমাকে ওরা। নিজেরা খানিকটা খেল। আর সবাই চলে গেল আমাকে রেখে। যেন আমি একা একটা রাত মেয়েটার কাছে থাকলে মনটা ভালো হয়ে যাবে। ওরা সত্যিই ভালো বন্ধু ছিল আমার। ওদের ধারণা যতটুকু করলে একজন বন্ধুকে খুব চাঙ্গা করে তোলা যায় তাই করেছে। ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে ঘুমোতে পারত সবাই মেয়েটাকে নিয়ে সে ইচ্ছে বলি দিয়েছে ওরা একজন বন্ধুর জন্যে।
ওরা যখন চলে গেল রাত একটা। আমি প্রথমে কিছু বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ মেয়েটা হাসল, আর বুঝতে পারলাম আমি একা। কিন্তু সে বোঝাটাও স্পষ্ট করে নয়– মাথার মধ্যে নয়–রক্তের ভেতরে যেন ছলাৎ করে উঠল। আমি উঠে বাইরে গেলাম, নাম ধরে ডাকলাম ওদের, কিন্তু সাড়া পেলাম না।
রাস্তাটা জনশূন্য। আজ আমার ভাবতে অবাক লাগে নিয়তিই বোধহয় আরেকবার, বোধহয় শেষবারের মতো আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তখন; নইলে পা টলছে নেশায়, মাথা ঘুরছে মিলের চাকার মতো, তবু অতটা পথ হাঁটলাম কী করে?
বেরুতেই মেয়েটা আমাকে ধরে ফেলল। বলল, যাচ্ছেন কোথায়?
বললাম, কী চাও? টাকা?
জানতাম, অন্তত একটু আমার জ্ঞান ছিল, বন্ধুরা সমস্ত টাকা দিয়ে গেছে, এমনকি মেয়েটার জন্যেও। তাই সে যখন বলল–হ্যাঁ টাকা–তখন আমি কুৎসিত একটা গাল দিয়ে তার হাত ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আমার জামা থেকে। সে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আমার বন্ধুদের নাম ধরে উচ্চকণ্ঠে ডাকতে ডাকতে পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
কেউ নেই ওরা। কোথায় গেল? আমার রক্তের ভেতর থেকে ডাক উঠছে ওদের জন্যে। একা লাগছে। আমি আরো জোরে ডাকতে লাগলাম, আসাদ, লোকমান, সমশের। কান পেতে রইলাম যদি ওদের কণ্ঠে শুনতে পাই আমার নাম, মুশতা–ক।
রাতের অন্ধকার থেকে একটানা শব্দ শুনছি ঝিঁঝির, আর কিছু না। আকাশে কোটি কোটি নক্ষত্র জ্বলছে, যেন তাদেরও পুড়ে যাবার চিড় চিড় শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার নাম ধরে ডাকছে না কেউ। আবার আমি ডাকলাম, লোকমা–ন।
ফকিরাপুল পেরিয়ে, নটরডেম কলেজ ছাড়িয়ে এসে পড়লাম মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়ার চৌরাস্তায়। চারটা পথ চলে গেছে চারদিকে। কোন দিকে যাবো? পেছনের পথটা আমাকে নিয়ে যাবে যেখান থেকে আমি উঠে এসেছি। বন্ধুরা গেছে সমুখে। তিনটে পথের কোটা ধরে? আমি জানতাম কে কোথায় থাকে, কিন্তু সেই নেশাগ্রস্ত মুহূর্তে তা মনে পড়ল না। আমার মনে হলো, পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ওরা। তাই ভয় করতে লাগল আরো। উন্মাদের মতো আবার আমি ডাকলাম ওদের নাম ধরে।