ওরা ছিল কয়েকজন চমৎকার বন্ধু। কোনো প্রশ্ন করত না, আমার কোনো কিছুই জানতে চাইতো না, দিনমানে কী করি, আমার সংসার আছে কী নেই–এসব ওদের কাছে তুচ্ছ। আমার তো মনে হয়, আমার পুরো নামটাও ওরা কেউ বলতে পারবে না। অথচ কত গভীরভাবে আমরা একে অপরকে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। মানুষ যখন স্কুল বানায়, দেশ চালায়, সংসার করে, হাসপাতাল কী মসজিদের পরিকল্পনা করে তখন তারা একজন আরেকজন সম্পর্কে কিছু না জেনে একসঙ্গে মিলিত হতে পারে অথচ সেই মানুষই যখন একসঙ্গে জুয়ো খেলে, মদ্যপান করে, ধর্ষণে সঙ্গী হয়, রাহাজানির জন্যে জোট পাকায় তখন কত সহজে এবং পরস্পরের কত কম তথ্য জেনে হাতে হাত মেলাতে পারে। আসলে, আমাদের রক্তের ভেতরে রয়েছে পাপ আর বুদ্ধির মধ্যে পুণ্যের ধারণা। এই পাপের বেসাতিতে বন্ধু জোটে সহজে। রক্তের ডাক বলেই হয়ত পাপের বন্ধু যত নিকট হতে পারে পুণ্যের বন্ধু ততখানি হতে পারে না।
আমরা একসঙ্গে মদের টেবিলে প্রাণ খুলে সব কথা বলতাম, বিশ্বাস করুন, কোনো রাখা ঢাকা ছিল না; পারতাম একজন আরেকজনের সমুখেই ট্রাউজারের বোম খুলে প্রস্রাব করতে; আরো পারতাম মেয়েমানুষের ঘরে একজন ঢুকলে বাকি সবাই বাইরে অপেক্ষা করতে, আর পারতাম সরকারকে নির্ভয়ে গালি দিতে, বেপরোয়ার মতো দেশনায়কদের সম্পর্কে যা খুশি তা বলতে–যার একাংশ বাইরে গেলে নির্ঘাত রাষ্ট্রদ্রোহীতার দায়ে পড়তে হতো। আমার সময়গুলো কাটছিল চমৎকার। জীবন মৃত্যুর দায়মুক্ত পরমপুরুষের মতো মনে হতো আমার নিজেকে–যার পাপে পাপ নেই, পুণ্যে প্রয়োজন নেই, বন্ধন যার কাছে এক অশ্রুত শব্দ।
আমি জানি, আপনারা চমকে উঠেছেন মেয়েমানুষের উল্লেখে। আমি নিজেও এখন কম আশ্চর্য বোধ করি না, যখন পেছনের দিকে তাকিয়ে আমার এ ছবিটা দেখতে পাই। আমিওতো কোনদিন ভাবিনি, এরকম হয়ে যাবো। আমার বরাবর ধারণা ছিল, পুণ্য বরং সহজে করা যায়, কিন্তু পাপ করতে রীতিমত প্রস্তুত হতে হয়ে নিজেকে। যখন আমি এম.এ পড়তাম তখন কী জানি কীভাবে আমার মাথায় ঢুকেছিল কোনো মেয়েমানুষের সঙ্গে রাত কাটাবার খেয়াল। কার কাছে যেন শুনেছিলাম জিন্নাহ এভেন্যুর মোড়ে দাঁড়ালেই সন্ধ্যের সময় দালাল এসে কাছে দাঁড়ায়, শ তিরিশ টাকা লাগে। কয়েক মাস ভাবতে ভাবতে অবশেষে একবার সদ্য পাওয়া চাচাদের মনি অর্ডার থেকে তিরিশ টাকা পকেটে ফেলে রাত আটটায় জিন্নাহ এভেন্যুতে এসে দাঁড়ালাম। মা তো ভোঁ ভোঁ করছিলই, যখন এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছি আমার হৃদপিণ্ড যেন হাজারখানেক সৈন্যের মতো দুমদুম করে মার্চ করে চলেছে, আর কোনো কিছু শুনতে পাচ্ছি না। ডিসেম্বরের শীতে পেয়েছে যেন ট্রাউজারের ভেতরটা। একটা করে তোক নির্লিপ্ত মুখে ছায়ার মতো এগিয়ে আসে, আমার মনে হয়, এখুনি বিস্ফোরণ হবে কোথাও, মরে যাবো, লোকটা চলে যায়।
সে রাতে একাই ফিরে আসতে হয়েছে। কিছু হয়নি। কোনো দালালের দেখা পাইনি। দেখা পেলেও যে যেতাম তা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কেমন একটা মোহের মতো পেয়ে বসেছিল, কোনো বোধই ছিল না। যখন ফিরে এলাম আবার এত স্বচ্ছন্দ মনে হলো নিজেকে যেন ফাঁসির আসামি খালাস পেয়ে বাড়ি যাচ্ছি।
সেই আমি মাত্র কয়েক বৎসর পরে কত সহজে পয়সা দিয়ে পাওয়া একটা মেয়েকে অভিজ্ঞ শিকারীর মতো কোলে টেনে সিক্ত চুমো দিতে পেরেছিলাম। আর যখন মেয়েটা আমাকে লোক দেখানো খিদে বাড়ানো লজ্জা দিয়ে দূরে রাখবার চেষ্টা করছিল, আমি তাকে হ্যাঁচকা টানে বিছানায় ফেলে তার ওপরে শরীরের সমস্ত ভার ছুঁড়ে দিয়ে বলতে পেরেছিলাম, খুব হয়েছে। বাইরে আরো তিনজন বসে আছে তোমার জন্যে।
অবশ্যি এটা খুব নিয়মিত কিছু ছিল না, যেমন তাস বা মদ। ঝোঁক উঠলে, কিংবা ভালো কিছুর খবর পাওয়া গেলে বেরুতাম। একবার একজনের সঙ্গে শুতে গিয়ে মাথার মধ্যে ঘুরে। উঠল নিশাতের ছবি। আমার মনে হলো, বিয়েটা যদি হতো তাহলে আজ এই মেয়েটার বদলে নিশাতের শরীর আমার নিচে নৌকোর মতো দুলে দুলে উঠতো। পরপর কয়েকদিন রোজ রাতে রোখ উঠতো আমার, আর আমি বেরুতাম। নিত্য নতুন চাই। আরো নতুন। আমি ও-রকম সময়গুলোতে চোখ বুজে শরীর আর মনকে কেন্দ্রীভূত, ভয়াবহ ও বিক্ষুব্ধ করতে করতে কল্পনা করতাম নিশাতকে। কানে যেন শুনজে পেতাম নিশাতের কণ্ঠস্বর, তার অনুনয়।
নিশাতের সঙ্গে বিয়ে হবার কোনো বাধাই ছিল না। তবু হলো না। আজকাল আমি ভাগ্যদেবী হয়ে উঠেছি এবং আগেই বলেছি, এখন আমার মনে হয় অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ আমাদের নিছক কল্পনা। সবকিছুই ঘটেছে এবং ঘটবে। জীবন এক অসম্ভব প্রস্তাব এবং তার সমাধা করতে হলে আমাদের কর্মগুলোকে অসম্ভবের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। নিশাতের সঙ্গে যে আমার বিয়ে হবে না তার ইঙ্গিত অনেক আগেই আমার পড়ে নেয়া উচিত ছিল, যা তখন আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। বিয়ের কথা যেদিন বলব সেদিন নিউমার্কেটের কাছে স্কুটার অ্যাকসিডেন্ট হতে হতে আমরা বেঁচে গেলাম। নিশাত বিয়েতে রাজি হয়ে যখন বাসে উঠে চলে গেল, তখন পকেটে হাত দিয়ে দেখি আমার পকেট কাটা গিয়েছে। তবু আমি লিখন পড়তে পারিনি। আর শেষ অবধি এই নিশাতের কারণেই আমি জানতে পেলাম, আমার হাতে মৃত্যু হয়েছে বাবার; এই যে দুটো হাত, এই হাতে ধাক্কা দিয়েছি তাকে, পড়ে গেছেন বর্ষায় উন্মত্ত নদীতে সাঁতার জানতেন না, মৃত্যু থেকে জীবনের পাড়ে আর উঠে আসতে পারেননি তিনি।